ইতিহাস সাক্ষী যখন কোন পুরুষ তার ধমনীর উপর নারীর প্রভুত্ব স্বীকার করে নেয় তখন সে পুরুষ শুধু নিজেই ধ্বংস হয় না; বরং সে যদি কোন খান্দানের কাণ্ডারি হয় তাহলে সেই খান্দানেরও ভরাডুবি করে। আর যদি কোন রাজ্যের বাদশাহ হয়, তাহলে সেই রাজ্যকে ধ্বংস ও বরবাদ করে ছাড়ে।
কুলসুম সুলায়মানের স্ত্রী ছিল নাকি হেরেমের রক্ষিতা ছিল–এ ব্যাপারে সঠিক কোন তত্ব পাওয়া যায় না। তবে ইতিহাসে এমন বেশুমার ঘটনা বর্ণিত আছে, যা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সুলায়মান ছিলেন নারীলোভী, একনায়কতন্ত্রী, রক্তপিপাসু, স্বৈরচার এক বাদশাহ।
তার হুকুমত ছিল মূলত খেলাফতের নামে মোড়া রাজতন্ত্র। বাহ্যত তিনি হজ্জ আদায় করতে এসে ছিলেন, কিন্তু প্রভাব বিস্তারের উদ্দেশ্যে জাকজমকের কোন কমতি ছিল না। তার সাথে ছিল হেরেমের শোভা কুলসুম ও অসংখ্য দাস দাসী, আর ছিল রক্ষীবাহিনী ও গুপ্তচর বাহিনী। তিনি আল্লাহর দরবারকে নিজের দরবার বানিয়ে নিয়েছিলেন।
সন্ধ্যায় দুই বার্বার সরদারকে শাস্তির নির্দেশ দিয়ে রাতের আঁধারে খলীফা তার প্রাসাদসম তাঁবু থেকে বের হয়ে এমন এক জায়গায় এসে পৌঁছলেন যেখানে মুসা বিন নুসাইর রাত্রি যাপন করতেন। খলীফার সাথে ছিল দুজন সিপাহী ও দু’জন মশালধারী। মুসা বিন নুসাইর সারা দিনের ক্লান্ত শরীর মাটিতে এলিয়ে দিয়ে ঘুমোচ্ছিলেন।
সুলায়মান মুসা বিন নুসাইরের পাঁজরে পা দিয়ে খোঁচা দিয়ে বললেন, ‘উঠ বুড়ো।
দুর্বল বয়োবৃদ্ধ মুসা বিন নুসাইর বহু কষ্টে উঠে বসে চোখ মেলে তাকালেন।
‘মনে হচ্ছে, তুমি বোধশক্তি ফিরে পাচ্ছ।’ সুলায়মান বললেন। ঐ দুই বার্বার তোমার সাথে বিদ্রোহের কথা বলছিল, আর তুমি তাদের বাধা দিচ্ছিলে।’
‘তোর ভয়ে নয়, সুলায়মান। মুসা বিন নুসাইর আসমানের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন। আল্লাহর ভয়ে। আমি তোর খেলাফতের কোন পরওয়াই করি না। তোকে মোটেই ভয় পাই না।
‘বদবত! তুই কি মনে করি, আমার অন্তরে আল্লাহর ভয় নেই।’ সুলায়মান বিদ্রুপের হাসি হেসে বললেন।
‘না, তোর অন্তরে মোটেই আল্লাহর ভয় নেই। মুসা বললেন। “তুই তো আল্লাহর হুকুম-আহকাম সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ। কুরআন খোলে দেখ, আল্লাহর তা’আলার হুকুম হল, “তোমরা হজ্জ করতে এসে নিজ স্ত্রীদের থেকে দূরে থাক। মন্দ কাজ থেকে বিরত থাক। লড়াই-ঝগড়ায় লিপ্ত হয়ো না। তোমরা যে নেক কাজ করবে আল্লাহ তা জানতে পারবেন। হজ্জের সফরে সাথে পাথেয় রাখ। মনে রাখবে, সর্বোত্তম পাথেয় হল, (সর্ব বিষয়ে) সংযম প্রদর্শন করা। সুতরাং হে বিবেকবান লোক সকল! তোমরা আমার নাফরমানী করো না।” সুলায়মান, তুই কি আল্লাহর এই হুকুম মেনে চলিস?’
খলীফা সুলায়মান মুসা বিন নুসাইরের প্রতি অবজ্ঞাভরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চলে গেলেন।
***
হজ্জ শেষ হয়ে গেছে। হাজিগণ নিজ নিজ দেশে ফিরে যাচ্ছেন। খলীফা সুলায়মানের কাফেলাও দামেস্কের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেছে। মুসা বিন নুসাইরকেও কাফেলার সাথে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সামান্য সময়ের জন্য তাঁকে উটে আরোহণ করানো হত, আর সারা দিন তিনি পায়ে হেঁটে চলতেন। তিনি ভিক্ষা করে যা কিছু জমা করে ছিলেন, খলীফা তা নিয়ে নিয়েছেন।
দেড়-দুই মাস পর কাফেলা দামেস্ক এসে পৌঁছলে মুসা বিন নুসাইরকে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হল। দামেস্ক পৌঁছার পর প্রথম রাতেই কুলসুম খলীফাকে স্মরণ করিয়ে দিল যে, আন্দালুসিয়ার আমীর এখন মুসার ছেলে। সে তার বাবার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য যে কোন সময় আন্দালুসিয়ার স্বাধীন শাসক হিসেবে বিদ্রোহ করতে পারে।
‘কুলসুম!’ সুলায়মান বললেন। আমি মুসলমানদের খলীফা। মুসলমানগণ এক নতুন রাজ্য জয় করেছেন। সেখানে নতুন নিয়ম-কানুন আরোপ করা হচ্ছে। এখনও খণ্ড খণ্ড লড়াই চলছে। খলীফা হিসেবে আমার কি সেখানে যাওয়া উচিত নয়? আমি যদি সেখানে যাই তাহলে সর্বসাধারণের নিকট আমার গুরুত্ব ও গ্রহণযোগ্যতা অবশ্যই বৃদ্ধি পাবে।
‘না, খলীফাতুল মুসলিমীন!’ কুলসুম বললআমার ভয় হয়, যারা আপনার সাথে যাবে তাদের মধ্যে কেউ যদি বলে দেয়, মুসা বিন নুসাইর এখন কারাগারে, তার অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়, তাহলে সেখান থেকে যিন্দা ফিরে আসা আপনার পক্ষে অব হয়ে পড়বে।’
‘কিন্তু সেখানের অবস্থা সম্পর্কে আমার অবগত হওয়া উচিত। সুলায়মান। বললেন। বিদ্রোহের সামান্য আভাস পেলেও আমি আবদুল আযীযকে তার আসল ঠিকানায় পৌঁছে দেব।’
পরের দিন খলীফা সুলায়মান সর্বাগ্রে একজন দূতকে দ্রুতগতিসম্পন্ন ঘোড়ায় সওয়ার করিয়ে আন্দালুসিয়ার উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দিলেন। তাকে বলে দেওয়া হল, সেখানকার সাঠিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সংবাদ সংগ্রহ করে অতিদ্রুত দামেস্ক ফিরে আসতে।
খলীফা তাকে বললেন, কেউ যেন জানতে না পারে যে, তুমি আমার প্রেরিত দূত। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবে, আন্দালুসিয়া এসেছি, এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করা যায় কিনা দেখতে।
***
আন্দালুসিয়ার যাবতীয় সংবাদ সংগ্রহ করে যথা সম্ভব দ্রুত ফিরে আসতে দূতের দেড় মাস লেগে গেল। এই দেড়মাস মুসা বিন নুসাইরের প্রতি নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, তিনি যেন খুব ভোরে কারাগার থেকে বের হয়ে শহরে ভিক্ষাবৃত্তি করেন, আর সন্ধ্যার পূর্বেই ফিরে এসে কারা-রক্ষকের নিকট সংগৃহীত টাকা জমা করে দেন।