দিয়েছিলেন। প্রচণ্ড রোদের মাঝে উত্তপ্ত বালুর উপর তাঁকে ঘন্টার পর ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখা হত। উত্তপ্ত বালু আর তীব্র রোদ্রের দহনজ্বালা সহ্য করতে না পেরে তিনি বেহুশ হয়ে পড়ে যেতেন। তাঁকে জীবিত রাখার জন্য কয়েক টুক পানি, আর সামান্য খাবার দেওয়া হত।
মুসা বিন নুসাইরকে খলীফা ওলিদ বিন আবদুল মালেক বিশেষ এক উদ্দেশ্যে আন্দালুসিয়া থেকে দামেস্ক ডেকে এনেছিলেন। কিন্তু তাঁর দুর্ভাগ্যই বলতে হয়, যখন তিনি এসে পৌঁছলেন তখন ওলিদ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করছিলেন।
ফলে সুলায়মান মুসার নাগাল পেয়ে যান। তিনি তাঁর উপর অন্যায় অপবাদ আরোপ করে নির্মম নির্যাতন চালান। সুলায়মান তার উপর দুই লাখ দিনার জরিমানা ধার্য করেন এবং তাঁকে মক্কা নিয়ে এসে জরিমানা আদায়ের জন্য ভিক্ষাবৃত্তি করতে বাধ্য করেন।
***
খলীফা সুলায়মানের ইঙ্গিতে ইউসুফ ও খিযিরকে টেনেহেঁচড়ে কামরার বাহিরে নিয়ে যাওয়ার পর কামরার এক পার্শ্বের পর্দা সরিয়ে একটি রূপসী, ষোড়শী মেয়ে কামরায় এসে প্রবেশ করলো। মেয়েটি দামেস্কের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী ছিল। সে সুলায়মানের পিছনে এসে দাঁড়াল। সে তার দুটি হাত সুলায়মানের কাঁধের উপর রেখে তার গলায় আঙ্গুলের আলতো পরশ বুলিয়ে দিতে লাগল। সুলায়মান তার হাত উঁচু করে মেয়েটির হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে নিলেন।
‘কুলসুম সুলায়মান নিচু স্বরে বললেন। যুবতী মেয়েটি সামনে এসে সুলায়মানের রানের উপর বসে পড়ল। তুমি শুনেছ, আমি কী করেছি?
‘হ্যাঁ, আমীরুল মুমিনীন! কুলসুম সুলায়মানের ঘন মোটের উপর আঙ্গুলের আলতো পরশ বুলিয়ে দিতে দিতে বলল। আমি পর্দার ওপাশে দাঁড়িয়ে সব শুনেছি।
সুলায়মান এক হাত দিয়ে কুলসুমের সরু কোমর জড়িয়ে ধরে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন, বদনসীব বাবার কোথাকার! আফ্রিকা থেকে এত দূরে আমার হুকুমে মরতে এসেছে। এদের কত বড় সাহস, মুসাকে বাঁচানোর জন্য বিদ্রোহের কথা বলে।
‘আপনি কি নিশ্চিত হয়ে গেছেন, আপনার হুকুমতে আর কেউ বিদ্রোহের কথা বলবে না? কুলসুম জিজ্ঞেস করল।
‘যে বিদ্রোহ করবে তারও এই পরিণতি হবে। সুলায়মান বললেন। মানুষ আমাকে জালেম বলবে, ঐতিহাসিকগণ আমাকে রক্তপিপাসু শ্বৈরাচার লিখবে; কিন্তু পরবর্তী প্রজন্ম এ কথা শুনবে না যে, আমার শাসনামলে কোন রাজ্যে বিদ্রোহ হয়েছে।
‘আমিরুল মুমিনীন! এটা কী আপনার ভ্রান্ত ধারণা নয়?’ কুলসুম বলল। শুধুমাত্র দু’জন বার্বার সরদারকে হত্যা করে বিদ্রোহের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’
কুলসুম খলীফার সাথে আবেগঘন চিত্তাকর্ষক অঙ্গ-ভঙ্গি করে বলল। আপনি মুসাকে কয়েদ করে অনেক বড় বিপদ ডেকে এনেছেন।
সুলায়মানের অর্ধনিমীলিত মুগ্ধ দৃষ্টি কুলসুমের চেহারার উপর স্থির হয়ে রইল। তার দেহ-মন যেন কোন এক অজানা জাদুর আবেশে অবশ হয়ে আসছিল।
‘আপনি ভেবে দেখেছেন কি, মুসা তার ছেলে আবদুল আযীযকে আন্দালুসিয়ার আমীর নিযুক্ত করে এসেছে। কুলসুম বলল। হয়তো আবদুল আযীযের নিকট এ খবর পৌঁছে গেছে যে, তার বাবাকে নির্যাতন করে মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। তারিক বিন যিয়াদকে আপনি নযরবন্দী করে রেখেছেন, যেন সে দামেস্কের বাইরে যেতে না পারে। আবদুল আযীয আর তারিক একই আদর্শের অনুসারী। আন্দালুসিয়ার তামাম ফৌজ মুসা, তারিক বিন যিয়াদ আর আবদুল আযীযকে পীরের মতো ভক্তি-শ্রদ্ধা করে।
‘তুমি কি বলতে চাচ্ছ, আবদুল আযীয আমাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করবে?
‘কেন নয়, সে তার বাবার বেইজ্জ্বতীর প্রতিশোধ অবশ্যই নিতে চাইবে। সে আযাদীর এলানও করে বসতে পারে। বিশাল এক সেনাবাহিনী রয়েছে তার। আপনি হয়তো ভুলে গেছেন, অর্ধেকের চেয়ে বেশী ফৌজ বার্বার। বার্বাররা আইনত এ দাবি করতে পারে যে, তারাই আন্দালুসিয়ার বিজেতা। আজ আপনি দুজন বার্বার সরদারকে শাস্তি দিয়েছেন। অন্য যে বার্বাররা হজ্জ করতে এসেছে তারা নিশ্চয় তাদের সরদার দুজনকে তালাশ করবে। যেভাবেই হোক তারা জানতে পারবে, আপনি তাদের সাথে কী আচরণ করেছেন।’
‘থামো, আমি তো আবদুল আযীয বিন মুসা সম্পর্কে কোন চিন্তাই করিনি। আমাকে কিছুক্ষণ ভাবতে দাও।’ সুলায়মান বললেন।
***
খলীফা সুলায়মান বিন আবদুল মালেকের চিন্তা-চেতনায় আত্মঅহমিকা আর ক্ষমতার দাপট জেঁকে বসেছিল। কুলসুমের রূপ-সৌন্দর্য আর মোহনীয় অঙ্গ-ভঙ্গি তার নেশার মোহ বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল।
খলীফার মসনদে বসার কয়েক মাস পূর্বে তার হেরেমে কুলসুমের আগমন ঘটে। সুলায়মানের এক বন্ধুর তোহফা ছিল কুলসুম। সে তার জাদুর ছোঁয়ায় যে কোন পুরুষকে ইশারায় নাচানোর মতো প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। সে এসেই সুলায়মানের দেহ-মন জয় করে নিলো। আর হেরেমের অন্য সকল মেয়েদেরকে তার হুকুমের দাসী বানিয়ে ফেলল।
কুলসুমের রূপে ও অঙ্গ-ভঙ্গিতে জাদু ছিল কি ছিল না, কুলসুম জাদুবিদ্যায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিল কি ছিল না–এটা বড় কথা নয়; বড় কথা হল, সুলায়মান বিন আবদুল মালেকের ঈমান ছিল কমজোর। তিনি ছিলেন নারী ও মদের নেশায় বিভোর। উম্মতে মুহাম্মদীর দুর্ভাগ্য যে, তার মতো ব্যক্তি খলীফা নিযুক্ত হয়েছেন। তিনি তার কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে খেলাফতকে রাজতন্ত্রে পরিণত করেন। তিনি অন্যান্য রাজা-বাদশাহদের ন্যায় স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা চালু করেন।