আন্দালুসিয়ার আরেক বিজেতা, আফ্রিকার আমীর মুসা বিন নুসাইরের পায়ে বেড়ি বেঁধে আপনি তাঁকে ভিখারি বানিয়েছেন। আন্দালুসিয়া গিয়ে দেখুন, আজ এই বার্বাররাই সেখানে ইসলামের ঝাণ্ডা উঁচু রেখেছে।
‘শুনেছি, মুসার এই অপমান আর লাঞ্ছনার প্রতিশোধ তোমরা আমার থেকে নিতে চাও। খলীফা বললেন। “তোমাদের এত বড় দুঃসাহস যে, তোমরা আমাকে হত্যা করতে চাও? আমার খেলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতেও তোমাদের কোন দ্বিধা নেই?
‘মুসা বিন নুসাইয়ের সাথে আমাদের যে কথা হয়েছে, আপনার গুপ্তচর যদি সে কথা আপনার কাছে পৌঁছিয়ে থাকে তাহলে আমরা তা অস্বীকার কবর না। ইউসুফ বললেন।
‘খলীফা, আপনি মুসার কৃতজ্ঞতা আদায় করুন। খিযির বললেন। তিনি আমাদেরকে বিদ্রোহ করা থেকে নিবৃত করেছেন। তাঁর কথা কি আপনার কানে এসে পৌঁছেনি? তিনি বলেছেন, বিদ্রোহের নামও নিও না। অন্যথায় ইসলামী সালতানাত কমজোর হয়ে যাবে। অথচ আপনি ইসলামের শিকড় কাটার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন।
খলীফা রাগে-গোসায় উন্মাদ হয়ে চিৎকার করে বলে উঠলেন, এই কে আছ, এই বদযবান জংলীদের এখান থেকে নিয়ে যাও। এদেরকে দামেস্কের কয়েদখানায় পাঠিয়ে দাও। এটাই এদের শেষ ঠিকানা।
তৎক্ষণাৎ ছয়-সাত জন সিপাহী কামরায় এসে প্রবেশ করল। তাদের উন্মুক্ত তরবারীর অগ্রভাগ ইউসুফ ও খিযিরের শরীর স্পর্শ করল। সিপাহীরা তাদেরকে টেনেহেঁছড়ে কামরার বাহিরে নিয়ে গেল।
ইউসুফ ও খিযির খলীফার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলতে লাগলেন। হজ্জ আদায়ে বাঁধা দানকারী জালেম। তোমার বাদশাহীর দিন শেষ হয়ে এসেছে।
তাদের চিৎকার-চেঁচামেচি ক্ষীণ হতে হতে হাজিগণের আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক’ ধ্বনির মাঝে হারিয়ে গেল। তার পর এই দুই সরদারের আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।
***
খলীফা সুলাইমান বিন আবদুল মালেক হলেন ওলিদ বিন আবদুল মালেকের ভাই। সুলাইমানের পূর্বে ওলিদ খলীফা ছিলেন। ওলিদের ইচ্ছা ছিল, তাঁর মৃত্যুর পর খলীফা হবেন তার ছেলে। কিন্তু আকস্মিকভাবে তিনি এমন এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পরেন যে, অল্প কিছু দিনের মধ্যেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। খলীফা হিসেবে ছেলের নাম পেশ করাও তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে সুলায়মান খেলাফতের মসনদ দখল করে বসেন।
ওলিদ ও সুলায়মান দুই ভাই। কিন্তু তাঁদের উভয়ের মাঝে যথেষ্ট পার্থক্য ছিল। ওলিদ মুহাম্মদ বিন কাসেমকে হিন্দুস্তান আক্রমণ করার জন্য পাঠিয়ে ছিলেন। তিনি তাকে ফৌজ প্রেরণসহ সবধরনের সহযোগিতা প্রদান করেছিলেন। একই সময়ে তিনি উত্তর আফ্রিকার আমীর মুসা বিন নুসাইরের সেই ঐতিহাসিক পরিকল্পনা অনুমোদন করেছিলেন, যে পরিকল্পনা অনুযায়ী বার্বার বংশোদ্ভূত সিপাহসালার তারিক বিন যিয়াদের নেতৃত্বে আন্দালুসিয়ায় আক্রমণ করা হয়েছিল। ওলিদ শুধু আন্দালুসিয়া আক্রমণের অনুমতিই দেননি; বরং আক্রমণ পরিচালনার জন্য যত ধরনের সাহায্য সহযোগিতার প্রয়োজন ছিল, সব কিছুই তিনি আঞ্জাম দিয়েছিলেন।
ওলিদের ভাই সুলায়মান যখন খলীফা নিযুক্ত হন তখন হিন্দুস্তানে মুহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু পর্যন্ত ইসলামী সালতানাতের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছিলেন। নতুন নতুন এলাকা বিজিত করার জন্য তিনি দুর্বার গতিতে সামনে অগ্রসর হচ্ছিলেন। অপর দিকে মুসা বিন নুসাইর, আর তারিক বিন যিয়াদ আন্দালুসিয়ার শহর-নগর-বন্দর জয় করে অপ্রতিরোধ্য গতিতে সামনে এগিয়ে চলছিলেন।
সুলায়মান খলীফা নিযুক্ত হয়েই হিন্দুস্তান থেকে মুহাম্মাদ বিন কাসেমকে একজন অপরাধী হিসেবে ফিরিয়ে আনেন। তিনি তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করে নির্মম নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করেন। সেই সাথে তিনি আন্দালুসিয়ার বিজয় অভিযানও মুলতবী করার নির্দেশ জারি করেন। তিনি মুসা বিন নুসাইর ও তারিক বিন যিয়াদকে দামেস্কে ডেকে এনে কারাগারে নিক্ষেপ করেন।
ওলিদের ছেলে যদি খলীফা হতেন এবং বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করতেন তাহলে ইউরোপ আর হিন্দুস্তানের ইতিহাস আজ অন্য রকম লেখা হত। ঐতিহাসিকগণ লেখেন, হিন্দুস্তান এবং ইউরোপে মুসলিম সৈন্যবাহিনী প্রেরণের ব্যাপারে কুতায়বা বিন মুসলিমের বিরাট ভূমিকা ছিল। কুতায়বা সে সময় চীন দেশে জিহাদ পরিচালনা করছিলেন। সুলায়মান তাকেও দামেস্ক ডেকে এনে জিঞ্জিরে আবদ্ধ করে কারাগারে নিক্ষেপ করেন।
***
মুসা বিন নুসাইর হজ্জের দিনগুলোতে মক্কার অলিগলিতে ভিক্ষা চেয়ে ফিরছিলেন। সারা দিন ভিক্ষা করে যে পয়সা জমা হত, তিনি তা খলীফা সুলায়মানকে দিয়ে দিতেন। মুসা খোলা আকাশের নিচে বসে থাকতেন। তাঁর জন্য একজন পাহারাদার নিযুক্ত করা ছিল। তাকে কোন প্রকার খাদ্যদ্রব্য দেওয়া হত না। তিনি ভিক্ষা করা পয়সা থেকে খানা কিনে খেয়ে নিতেন। দীর্ঘ এক বছর যাবৎ তিনি এই নির্যাতন সহ্য করে আসছিলেন। খলীফা সুলায়মানের নিকট তাঁর আজীবনের বিজয়-কীর্তির কোন মূল্যায়ন ছিল না। উপরন্তু তাঁর বার্ধক্যের প্রতিও তিনি কোন ভ্রূক্ষেপ করেননি।
মুসা বিন নুসাইর এখন তাঁর জীবন সফরের আখেরী মনযিলে এসে উপনীত হয়েছেন। খলীফা সুলায়মান ব্যক্তিগত বিদ্বেষবসত তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করেই ক্ষান্ত হননি, বরং অমানবিক নির্যাতন করে তার দেহ ক্ষতবিক্ষত করে