এর জবাব শুধু খলীফাই দিতে পারেন। আমরা হুকুমের গোলাম মাত্র। এক্ষুণি চল।’ সেই সিপাহীটি বলল।
‘যদি আমরা না যাই তাহলে…।’ খিযির জানতে চাইলেন।
‘তাহলে তোমাদেরকে ঘোড়ার পিছনে বেঁধে টেনেহেঁছড়ে নিয়ে যাওয়া হবে।’ সিপাহীটি বলল। এটাও খলীফার হুকুম। বুদ্ধিমানের কাজ হল, তার আগেই তোমরা আমাদের সাথে রওনা হবে।’
‘খলীফার নির্দেশ তোমরা এড়িয়ে যেতে পার না বন্ধু!’ মুসা বিন নুসাইর বললেন। তাদের সাথে চলে যাও। অপমান হওয়া থেকে বাঁচ। আল্লাহ তোমাদের হেফাযত করুন।
সিপাহীরা তাঁদেরকে নিয়ে চলে গেল। মুসা বিন নুসাইরের চোখ থেকে কফুটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।
***
হাজিদের তাঁবু থেকে সামান্য দূরে সারিবদ্ধ কয়েকটি তাঁবুর বসতি গড়ে উঠেছে। এ সকল তাঁবুর মাঝে একটি তাঁবু অনেক বড়। দেখতে তাঁবু মনে হলেও সেটি একটি শাহীকামরা। কামরার চতুর্পাশে বহু মূল্যবান রঙ্গিন রেশমী কাপড়ের পর্দা ঝুলছে। সূক্ষ্ম কারুকাজ করা শামিয়ানা কামরার উপর অংশে শুভা পাচ্ছে। শামিয়ানার চার পাশে সোনালী জরির নকশা করা ঝালর লাগানো হয়েছে।
তাঁবুর মধ্যখানে রয়েছে একটি বড় পালঙ্ক। পালঙ্কের উপর রেশমী সুতা দিয়ে বোনা মশারি পালঙ্কের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করছে। নিচে মহামূল্যবান গালিচা বিছানো। পালঙ্কের অনতি দূরে গদি লাগানো ছোট্ট একটি কুরসি। কুরসির সামনে সুন্দর নকশা করা একটি জলচৌকি। জলচৌকিটি দামি মখমলের কাপড়ে ঢাকা। কুরসিতে আসন গ্রহণকারী সেই জলচৌকিতে পা রাখেন।
সেই সুশোভিত নরম কুরসীতে একজন লোক বসে আছেন। তার চাকচিক্যময় আর জৌলুসপূর্ণ পোশাক দেখে যে কেউ বলে দিতে পারবে, নিশ্চয় তিনি কোন মুলুকের বাদশাহ হবেন।
এই জাঁকজমকপূর্ণ বিলাসবহুল কামরায় একজন সিপাহী এসে প্রবেশ করল। সিপাহী তার মাথা ঝুঁকিয়ে কুর্নিশ করে বলল। খলীফাতুল মুসলিমিন! তাদের দু’জনকে নিয়ে আসা হয়েছে।
‘তাদের সাথে কি কোন অস্ত্র আছে?’ খলীফা জিজ্ঞেস করলেন।
“না, জাঁহাপনা! তারা হজ্জের জন্য এহরাম বাধা অবস্থায় রয়েছে। তারা নিরস্ত্র। তাদের শরীরে তল্লাশী নেওয়া হয়েছে। সিপাহীটি বলল।
খলীফা সুলায়মান বিন আবদুল মালেক রাজকীয় ভঙ্গিতে মাথা সামন্য কুঁকালেন। সিপাহীটি উল্টাপদে কামরা থেকে বের হয়ে গেল।
কিছুক্ষণ পর ইউসুফ বিন হারেছ এবং খিযির বিন গিয়াস কামরায় প্রবেশ করলেন। তারা এক সাথে বলে উঠলেন, ‘আমীরুল মুমিনীন! আসোলামু আলাইকুম।
‘বার্বারদের সম্পর্কে আমি যা শুনেছি, তা ভুল শুনিনি।’ খলীফা বললেন।
‘সম্মানিত খলীফা বার্বারদের সম্পর্কে কী শুনেছেন? খিযির জানতে চাইলেন।
‘শুনেছি বার্বাররা শিষ্টাচার বিবর্জিত অসভ্য, হিংস্র। তোমাদের চেয়ে গ্রাম্য বেদুইনরা অনেক ভালো। তারা আদব-কায়দা সম্পর্কে গাফেল নয়।’
ইউসুফ ও খিযির বিস্ময়বিমূঢ় হয়ে একে অপরের দিকে তাকাতে লাগলেন। খলীফা রাজকীয় গাম্ভির্যের সাথে ধমকে উঠে বললেন।
‘আমার দিকে তাকাও, একে অপরের দিকে কী দেখছ? তোমাদের কোন কসুর নেই। তোমাদেরকে দরবারে খেলাফতের আদব শিখানো হয়নি, তাই তোমরা জান না যে, খলীফার সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে কুর্নিশ করতে হয়?
‘আমীরুল মুমিনীন!’ ইউছুফ বললেন। আমরা শুধু সেই দরবারে মাথা কুঁকাতে শিখেছি, এতদূর থেকে যেখানে হাজিরি দিতে এসেছি। মহান আল্লাহর সেই দরবারে আমরা শুধু মাথাই ঝুকাই না; বরং পরম ভক্তিভরে সেজদায় লুঠিয়ে পড়ি। ইসলাম আমাদেরকে এই আদবই শিক্ষা দিয়েছে।
এই মুহূর্তে তোমরা খলীফাতুল মুসলিমীনের দরবারে রয়েছ, এখানেও ঝুঁকে সালাম করা আবশ্যক। খলীফা রাগতস্বরে বললেন।
‘খলীফাতুল মুসলিমীন!’ ইউসুফ বললেন। আমরা এ জন্য ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলাম যে, ইসলামের রীতি-নীতি আমাদের কাছে ভালো লেগেছিল। ইসলামের হুকুম হল, মানুষ মানুষের সামনে মাথা ঝুঁকাবে না। একমাত্র আল্লাহর সামনে মাথা ঝুঁকাবে। আপনি যদি আমাদেরকে আপনার সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে সালাম করার হুকুম দেন তাহলে আমরা ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে আমাদের পূর্বের ধর্মে ফিরে যেতে বাধ্য হব।’
‘আমি ইসলামেরই খলীফা। আমাকে ইসলামের হুকুম-আহকাম শিখাতে এসো না। তোমাদের মতো অসভ্য, জংলী, হিংস্র বার্বার আমাকে ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান দেবে, এটা আমি বরদাশত করব না।’
‘খলীফা!’ খিযির উত্তেজিত হয়ে বললেন। আপনি যদি বার্বারদের সভ্যতা আর চারিত্রিক সৌন্দর্য দেখতে চান, তাহলে আন্দালুসিয়ায় গিয়ে দেখুন। আপনার হয়তো জানা নেই যে, আন্দালুসিয়া বিজয়ের জন্য বার্বাররা তাদের মাথার নাযরানা পেশ করেছিল।
‘তারিক বিন যিয়াদও বার্বার। ইউসুফ বললেন। খলীফা আজ আপনি যাদেরকে হিংস্র, জংলী আর অসভ্য বলছেন, তারাই একদিন আন্দালুসিয়ার কাফেরদের হৃদয়-রাজ্য জয় করে ইসলামের ছায়াতলে নিয়ে এসেছিল।
‘খলীফাতুল মুসলিমীন!’ খিযির বললেন। আপনি আন্দালুসিয়ার বিজেতাদের ডেকে এনেছেন। তাঁরা আন্দালুসিয়ার মাটিতে বিজয় পতাকা নিয়ে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। তারিক বিন যিয়াদ আন্দালুসিয়ার সমুদ্রসৈকতে ফৌজ নামিয়ে দিয়ে যুদ্ধ জাহাজে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন, যেন পালিয়ে যাওয়ার কোন রাস্তা না থাকে। কিন্তু যখন তিনি আন্দালুসিয়া জয় করে সামনে অগ্রসর হওয়ার চিন্তা করছিলেন তখন আপনি তাকে দামেস্ক ডেকে আনেন। আপনি তাঁর গর্বিত মস্তক মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছেন। আপনি চান, ইতিহাসের গহ্বরে তাঁর নাম যেন হারিয়ে যায়।