হজ্জ করতে আসা বার্বার সেই দুই সরদারও প্রকৃত মুসলমান হিসেবে মুসা বিন নুসাইরের হাতে দীক্ষা নিয়েছিলেন। তাঁরা নিজেদেরকে প্রকৃত মুসলমান হিসেবে গড়ে তুলে ছিলেন। তাদের মধ্যে একজন হলেন, ইউসুফ বিন হারেছ। অন্যজন খিযির বিন গিয়াস। ইসলাম গ্রহণের পর তাঁদের এই নাম রাখা হয়। তারা উভয়ে মুসাকে ভিখারি রূপে দেখা সত্তেও আগের মতোই সম্মান ও তাজীম প্রদর্শন করছিলেন।
‘আফ্রিকার সম্মানিত আমীর!’ ইউসুফ বিন হারেছ বললেন। আপনি বলুন, আমরা আপনার কী মদদ করতে পারি?
‘কিছুই না।’ মুসা বিন নুসাইর বললেন। নিশ্চয় আল্লাহ আমাকে আমার কোন গুনাহের শাস্তি দিচ্ছেন।
‘কিছু একটা বলুন, ইবনে নুসাইর! আপনি চাইলে আমরা খলীফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করব।’ খিযির বিন গিয়াস বললেন।
ইউসুফ বিন হারেছ মুসার কানে কানে বললেন, ‘আমরা সুলায়মান বিন আবদুল মালেককে হত্যা পর্যন্ত করতে পারি। তিনি হজ্জ আদায়ের জন্য এসেছেন, কিন্তু লাশ হয়ে দামেস্ক ফিরে যাবেন।
তারপর কি হবে?’ মুসা বিন নুসাইর জিজ্ঞেস করলেন।
‘নতুন খলীফা আপনাকে এই শাস্তি থেকে অব্যহতি দেবেন।’ ইউসুফ বললেন। আমরা বুঝতে পারছি, আপনি সুলায়মান বিন আবদুল মালেকের ব্যক্তিগত আক্রোশের শিকার হয়েছেন।’
‘আমি যদি তাকে হত্যা করাই তাহলে আমিও আল্লাহর দরবারে ব্যক্তিগত হিংসা চরিতার্থকারী হিসাবে অপরাধী সাব্যস্ত হব। মুসা বিন নুসাইর বললেন। আমি নিজেই তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে পারতাম, কিন্তু বন্ধু আমার! আপন প্রাণের চেয়েও ইসলামের আজমত আমার নিকট অনেক বেশি প্রিয়। আমি এবং আমার পূর্ববর্তী আমীরগণ আফ্রিকায় তোমাদের জাতিগত বিদ্রোহ কেন দমন করে ছিলাম? তোমাদেরকে গোলাম বানানোর জন্য নয়; বরং মুসলমানদের মাঝে ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখার জন্য। কাফেরদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য।’
‘আমি আর কদিন বাঁচব? আমার জীবন-আকাশে আর কটা চাঁদ উদিত হবে? সুলায়মানও চিরকাল বেঁচে থাকবে না। তাকেও একদিন মরতে হবে। একমাত্র দ্বীন-ইসলামই যিলা থাকবে। একবার যদি খেলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হয় তাহলে এই বিদ্রোহের আগুন সে সকল মুলুককেও আক্রান্ত করবে, যেখানে ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমাকে তো কেবল নিজেকে বাঁচালে চলবে না। প্রাণপ্রিয় ধর্ম ইসলামকেও বাঁচাতে হবে।
এই দুই বার্বার সরদার যখন মুসা বিন নুসাইরের নিকট খলীফা সুলায়মানকে হত্যা করার পরিকল্পনা পেশ করছিলেন আর তার খেলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার কথা বলছিলেন, সেই মুহূর্তে এক হাজি সাহেব তাঁদের সামনে এসে দাঁড়াল। সে আগ্রহ নিয়ে তাঁদের কথা শুনতে লাগল। ইউসুফ তার দিকে তাকিয়ে বললেন।
‘তুমি কি এই বৃদ্ধ ভিখারির তামাশা দেখছ? তাঁকে কিছু দিতে হলে আল্লাহর নামে দিয়ে চলে যাও।’
‘আমার আফ্রিকান ভাই।’ লোকটি বলল। আমি তোমাদের কথা শুনছিলাম। এই বৃদ্ধের দুঃখের কথা শুনে আমার অন্তর ভারাক্রান্ত হয়ে গেছে। আল্লাহর কসম! এই বুযুর্গ যদি আমাকে নির্দেশ দেন তাহলে আমি জীবনবাজি রেখে খলীফাকে হত্যা পর্যন্ত করতে পারব। এই মহান ব্যক্তিকে যে চিনতে পারবে, সে এই কথাই বলবে, যা তোমরা বলছ, আর আমি বলছি।’
‘তুমি কে? খিযির তাকে জিজ্ঞেস করলেন। কথার টানে তোমাকে শামের অধিবাসী বলে মনে হচ্ছে।’
‘হা’, লোকটি বলল। তোমরা ঠিকই বুঝতে পেরেছ। আমি শামের অধিবাসী।
লোকটি তার থলি খোলে দুটি দিনার বের করে মুসা বিন নুসাইরের কোলের উপর নিক্ষেপ করে বলল, ‘আমি অতিসত্বর তোমাদের সাথে সাক্ষাৎ করব এবং কোন ভালো সংবাদ নিয়ে ফিরে আসব।’ এই বলে লোকটি চলে গেল।
“যে ব্যক্তি আপনাকে চিনতে পারবে সেই আপনার মুক্তির জন্য জীবনবাজি রাখতে প্রস্তুত হয়ে যাবে।’ খিযির বললেন।
‘কিন্তু নিজের জন্য আমি অন্যকে বিপদে ফেলতে পারি না।’ মুসা বিন নুসাইর বললেন। আমি কেবলমাত্র আল্লাহর কাছেই মুক্তি কামনা করি।’
‘আপনার মুক্তিপণের দুই লাখ দিনার আমরা আদায় করে দেব।’ ইউসুফ বললেন। তবে আফ্রিকা ফিরে যাওয়ার পর তা সম্ভব হবে। এখন তো আমরা শুধুমাত্র পথের পাথেয় নিয়ে এসেছি।’
‘আমার কবিতা আপনার কথা শুনলে দেরহাম-দিনারের স্তূপ লাগিয়ে দেবে। খিযির বললেন।
এই দুই বার্বার সরদার মুসা বিন নুসাইরের সামনে থেকে উঠার নামই নিচ্ছিলেন না। তাঁদের মনের মাঝে মুসার প্রতি ভক্তি ও আবেগের এমন এক ঝর্নাধারা বয়ে চলছিল যে, তাঁরা চাচ্ছিলেন, মুসাকে এখান থেকে উঠিয়ে নিজেদের সাথে নিয়ে যাবেন।
‘তোমরা চলে যাও।’ মুসা বিন নুসাইর তাঁদেরকে বললেন। আমি খলীফার কয়েদী। তিনি আমাকে এখানে বসিয়ে রেখে ভুলে যাননি। অবশ্যয় লোক পাঠিয়ে আমার উপর নরদারী করছেন। তিনি ভালো করেই জানেন, আমি যাদের আমীর ছিলাম, তাদের নিকট আমার মান-সম্মান নিঃশেষ হয়ে যায়নি। তারা আমাকে এই যিল্লতির মাঝে দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে যে কোন প্রকারের আঘাত হেনে বসতে পারে।’
কথা শেষ করে উভয় সরদার যখন উঠে দাঁড়াচ্ছিলেন তখন চার-পাঁচ জন সিপাহী নাঙ্গা তরবারী নিয়ে তাদেরকে ঘিরে ফেলল। সিপাহীদের একজন বলল, ‘খলীফা তেমাদের দু’জনকে তলব করছেন।’
‘আমাদের কাছে খলীফার কী প্রয়োজন?’ ইউসুফ জিজ্ঞেস করলেন।