হজ্জের দিনগুলোতে তারা মক্কা শরীফ চলে আসে। ভালো আয়-রোজগার করে হজ্জ শেষ হলে চলে যায়।
এই ভিখারিদের মাঝে একজন বৃদ্ধ ভিখারিও আছেন। এই ভিখারির মাঝে বিশেষ কোন বৈশিষ্ট্য নেই। অন্যান্য ভিখারির মতো তার লোবাসও ছিন্নভিন্ন। হাত পায়ে ময়লা। চেহারা ধূলিধূসরিত। দাঁড়িতে লেগে থাকা বালুকণা রোদের আলোতে চিকচিক করছে।
অন্যান্য ভিখারি ও তার মাঝে পার্থক্য শুধু এতটুকু যে, তিনি অত্যন্ত বৃদ্ধ ও কমজোর। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় না। চোখে পড়ার মতো আরেকটি বিষয়ও তার আছে, যে কারণে লোকেরা তার দিকে কিছুক্ষণ গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তার পা বেড়ি দিয়ে বাঁধা। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, তিনি একজন কয়েদি। বিশেষ অনুগ্রহে তাকে ভিক্ষাবৃত্তির অনুমতি দেয়া হয়েছে।
‘তুমি কয়েদি নাকি?’ প্রথম দিনই একজন হাজি সাহেব তাকে জিজ্ঞেস করলেন।
বৃদ্ধ সম্মতিসূচক মাথা উপরে নিচে করলেন। তাঁর চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো।
‘তুমি কি চুরি করেছ?” আরেকজন হাজি সাহেব জানতে চাইলেন।
‘চুরি করলে তো আমার হাত কেটে দেওয়া হত।‘ বৃদ্ধ তাঁর বলিষ্ঠ দুটি বাহু সামনের দিকে প্রসারিত করে উত্তর দিলেন।
‘কোন মেয়েলোকের সাথে ধরা পড়েছিলে নাকি?’ অন্য আরেকজন হাজি সাহেব জিজ্ঞস করলেন।
‘তাহলে তো আমি যিন্দা থাকতাম না। বৃদ্ধ কাঁপা কাঁপা আওয়াজে বললেন। ‘তাহলে তো আমাকে পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলা হত।
‘তাহলে কী অন্যায় করেছ তুমি?’ প্রথমজন জানতে চাইলেন। ‘ভাগ্য আমার সাথে প্রতারণা করেছে।’ বৃদ্ধ উত্তর দিলেন।
‘অপরাধীদের ভাগ্য এমনই প্রতারণা করে থাকে। দ্বিতীয়জন ফোড়ন কেটে বললেন।
বৃদ্ধ ভিখারির দৃষ্টি মুহূর্তের জন্য জ্বলসে উঠল। তিনি তাঁর আশ-পাশে দাঁড়ানো লোকগুলোর দিকে উদাস চোখে তাকিয়ে রইলেন।
‘অপরাধী তার অপরাধের কথা কখনও স্বীকার করে না। তৃতীয়জন দার্শনিকের ন্যায় মন্তব্য করলেন।
‘আমার অপরাধ হল, খলীফা ওলিদ বিন আবদুল মালেক ইন্তেকাল করেছেন। বৃদ্ধ ভিখারি বললেন। আর তার স্থানে তাঁর ভাই সুলায়মান বিন আবদুল মালেক খলীফা নিযুক্ত হয়েছেন। দামেস্কের কয়েদখানায় গিয়ে দেখ, আমার মতো বহু কয়েদি বিনা অপরাধে সেখানে শাস্তি ভোগ করছে।
অন্য একজন হাজি বললেন, “তুমি কে? তোমার নাম কি? কোন কবিতার সাথে তোমার সম্পর্ক?
‘আমার কোন নাম নেই। বৃদ্ধ ভিখারি বললেন। কেবলমাত্র আল্লাহ তা’আলার নামই অবশিষ্ট থাকবে। তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে আবারো বললেন। কেবলমাত্র আল্লাহর নামই অবশিষ্ট থাকবে…। যদি কিছু দাও তাহলে আল্লাহকে দেবে…। আল্লাহ তোমাদের হজ্জ কবুল করবেন। আমি আমার অপরাধের কথা বলতে পারব না। যদি বলি, তাহলে সেটাও আমার অপরাধ হবে। “ওয়া তুইঙ্গু মান তাশাউ ওয়া তুযিল্প মান তাশাউ…।” তিনি যাকে ইচ্ছা ইজ্জত দান করেন, যাকে ইচ্ছা বেইজ্জত করেন…।’
হাজিগণ কিছু পয়সা নিক্ষেপ করে চলে গেলেন। বৃদ্ধ ভিখারী তার পায়ে বাধা বেড়ি কাপড় দিয়ে ঢেকে দিলেন। এই বেড়ি দেখে মানুষের মনে যে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়, তার উত্তর তার জানা আছে, কিন্তু সে উত্তর দেওয়ার সাহস তার নেই। তিনি খলীফা সুলাইমান বিন আবদুল মালেকের সাথে দামেস্ক থেকে এসেছেন। খলীফার কাফেলার সাথে তাকে নিয়ে আসা হয়েছে। তার শাস্তি এটাই নিধারিত হয়েছে যে, তিনি মক্কা এসে ভিক্ষা চাইবেন।
তিনি হাত প্রসারিত করে চুপচাপ বসে থাকতেন। হাজিগণ তাঁকে বয়োবৃদ্ধ মনে করে অন্যদের তুলনায় সামান্য বেশিই দান করতেন। কিন্তু তিনি তাতে খুশী হতে পারতেন না।
এশার নামাযের পর হাজিগণ নিজ নিজ তাঁবুতে চলে গেলে তিনি উঠে সামান্য খাদ্য কিনে খেয়ে নিতেন। তারপর সারাদিনের সঞ্চয় গুনতে বসতেন। গুনা শেষ হলে তাঁর মন দমে যেত। তিনি আরো বেশী দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে পড়তেন। হজ্জের এই কয়েকটি দিনে তাকে দুই লাখ দিনার সগ্রহ করতে হবে। অল্প সময়ে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ সগ্রহ করা তাঁর পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হবে না।
তাঁর মনে হতো, তিনি চুপচাপ বসে থাকেন বলেই পয়সা কম পান। অগত্যা তিনি পয়সা চাইতে শুরু করলেন। কিন্তু অন্যান্য ভিখারিদের মতো দরদ মেশানো আওয়াজে ভিক্ষা চাইতে পারতেন না। তাদের মতো ক্ষুধার্ত শিশু-সন্তানের নাম করে কাঁদতে পারতেন না। তিনি একটিমাত্র কথাই বলতেন, তিনি যাকে ইচ্ছা ইজ্জত দান করেন, যাকে ইচ্ছা বেইজ্জত করেন।
***
বৃদ্ধ ভিখারি ভিক্ষা চাচ্ছিলেন। এমন সময় এক ব্যক্তি তার পিছন দিক থেকে এসে পা দিয়ে তাঁকে খোঁচা মারল। বৃদ্ধ ঘুরে তার দিকে তাকালে সে বলল, ‘বুড়ো, পালানোর চিন্তা করছ নাকি?
‘কখনও শুনেছ, আন্দলুসিয়ার জিহাদী ময়দান থেকে কোন মুজাহিদ পালিয়ে গেছে? বৃদ্ধ বললেন। আমি পালিয়ে যেতে চাইলে তো…।
‘এখনও তোমার দেমাগ থেকে আন্দালুসিয়ার খোয়াব দূর হয়নি? লোকটি তাকে আরেকবার আঘাত করে বলল।
“তোমার খলীফাকে বলে দিও, তার হুকুমত অতিসত্বর খতম হয়ে যাবে।’ বৃদ্ধ ভিখারি বললেন। মুহাম্মদ বিন কাসেমের হত্যাকারীকে আমার এই পয়গাম পৌঁছে দিও। আর তুমি আমাকে যে দুটি আঘাত করেছ, তার জবাব কেয়ামতের দিন দেব।’
আঘাতকারী তাচ্ছিল্যভরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চলে গেল।