খলীফাতুল মুসলেমীন! আমি এতো দিন তাদেরকে সিউটা আক্রমণ করা ও অবরোধ করার মাঝেই ব্যস্ত রাখতাম, কিন্তু বেশ কিছুদিন যাবত এই কাজটিও বন্ধ হয়ে আছে। এখন এই বার্বার সৈন্যবাহিনীকে কোন না কোন জিহাদী ময়দানের সন্ধান দেওয়া অত্যন্ত আবশ্যক হয়ে পড়েছে; যেন তারা দুশমনের খুন প্রবাহের নেশা পূর্ণ করতে পারে।
রক্ত প্রবাহের এই নেশা চরিতার্থ করা ছাড়া তাদেরকে প্রকৃত মুমিন ও মুজাহিদ বানানোর জন্যও আন্দালুসিয়া অভিমুখে জিহাদের উদ্দেশ্যে পাঠানো উচিত। কাফেরদের রাজ্যে গিয়ে তাদের সাথে জিহাদ করে যখন তারা বিজয় লাভ করবে এবং ইসলামের প্রচার-প্রসারের জন্য কাজ করবে তখন তাদের চিন্তা-চেতনায় ইসলামের জন্য মহব্বত সৃষ্টি হবে।‘
***
বার্তাবাহক বেশ কয়েকদিন পর খলীফা ওলিদ বিন আবদুল মালেকের পয়গাম নিয়ে উপস্থিত হল। খলীফার পয়গাম উৎসাহব্যঞ্জক ছিল। তবে খলীফা সতর্কতা অবলম্বনের ব্যাপারে খুব বেশি তাকিদ দিয়ে লেখেন :
সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যারা দ্বীন-ইসলাম থেকে বিমুখ তাদের উপর পরিপূর্ণ আস্থা স্থাপন করা উচিত হবে না। সতর্কতাস্বরূপ জুলিয়ানকে কোন না কোনভাবে পরীক্ষা করে নিতে হবে। সিউটার করদ-রাজা জুলিয়ান যদি পরীক্ষায় পুরোপুরি উত্তীর্ণ হয়, তাহলে দামেস্ককে অবহিত করলে এখান থেকে যুদ্ধ-রসদ ও জরুরি সামান-পত্ৰ অতি পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে।
মুসা বিন নুসাইর ভার উপদেষ্টা পরিষদকে খলীফার পয়গাম পড়ে শোনান। তিনি সকলের নিকট সুচিন্তিত পরামর্শ তলব করেন। আরবদের বিবেক-বুদ্ধি অত্যন্ত প্রখর ছিল। তারা অল্প কিছুক্ষণ মত-বিনিময়ের পর জুলিয়ানকে পরীক্ষা করার পন্থা বের করতে সক্ষম হল।
মুসা বিন নুসাইর তৎক্ষণাৎ একজন রাজদূতকে এই বলে সিউটা পাঠিয়ে দিলেন যে, পয়গাম পাওয়ামাত্রই যেন জুলিয়ান মুসা বিন নুসাইরের সাথে সাক্ষাৎ করেন।
জুলিয়ান এই সংবাদের অপেক্ষায়ই ছিলেন, সংবাদ পাওয়ামাত্রই তিনি তৈরি হয়ে নিলেন। তিনি তার সাথে আন্দালুসিয়ার ক্ষমতাচ্যুত বাদশাহ অর্টিজার ভাই আউপাস ও উচ্চপদস্থ একজন সেনা-অফিসারসহ একশত বিচক্ষণ রক্ষীসেনা নিয়ে রওনা হলেন।
এই রাজকীয় কাফেলা আফ্রিকার রাজধানী কায়রোয়ান’ এসে পৌঁছার সাথে সাথে জুলিয়ান মুসার সাথে সাক্ষাৎ করলেন। ঐতিহাসিকদের মতে এই সাক্ষাতে অর্টিজার ভাই আউটপাস এবং জুলিয়ানের উচ্চপদস্থ সেনা-কর্মকর্তাও উপস্থিত ছিল। এই সাক্ষাতের মাধ্যমেই মুসলমানদের জন্য আন্দালুসিয়ার দরজা খুলে গিয়েছিল।
‘ভাই জুলিয়ান, দামেস্ক থেকে অনুমতি পাওয়া গেছে।’ মুসা বিন নুসাইর বললেন। তবে শর্ত হল, তোমাকে এটা প্রমাণ করতে হবে যে, আন্দালুসিয়ার বাদশাহ রডারিককে তুমি এমনই এক দুশমন মনে কর যে, পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটলেও তার সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করবে না।’
‘এই প্রমাণ পেশ করার কী পদ্ধতি হতে পারে–আপনিই বলুন?’ জুলিয়ান বললেন। আমি তো শুধুই প্রহর গুণছি, সেই সময় কখন আসবে যখন আমি নরাধম রডারিক থেকে আপন কন্যার ইজ্জতের প্রতিশোধ নিতে পারব।’
‘মুহতারাম আমীর!’ আউপাস বলল। আমার সেই ভাইয়ের আত্মা আমাকে রাত্রে ঘুমোতে দেয় না, যার বিরুদ্ধে রডারিক বিদ্রোহ করে ছিল এবং যাকে ক্ষমতাচ্যুত করে নিজে বাদশাহ হওয়ার পর তাকে হত্যা পর্যন্ত করেছিল। এখন সে আমাদের খান্দানের উপর এমন এক আঘাত হেনেছে, যদি আপনি আমাদের স্থানে হতেন তাহলে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য একদিনও অপেক্ষা করা বরদাশত করতেন না। আপনার সৈন্যবাহিনীর মতো সৈন্যবাহিনী যদি আমাদের থাকত তাহলে আমরা সাহায্য ভিক্ষা চাওয়ার জন্য আপনার দরজায় এসে দাঁড়াতাম না।’
‘এখন আর অপেক্ষা করব না। মুসা বিন নুসাইর বললেন। জুলিয়ান! এক কাজ কর, তোমরা তোমাদের সৈন্যবাহিনী নিয়ে রাতের অন্ধকারে সদ্র পার হয়ে আন্দালুসিয়ার সমুদ্র তীরবর্তী কোন অঞ্চলে আক্রমণ করো। তবে আন্দাসুলিয়ার ফৌজ টের পাওয়ার আগেই তোমরা তোমাদের ফৌজ ফিরিয়ে আনবে। এই আক্রমণই একটা প্রমাণ হিসেবে থাকবে যে, তোমরা রডারিককে নিজেদের দুশমন মনে কর। আমি তোমাদের প্রতিশোধ স্পৃহার প্রচণ্ডতা অনুমান করতে চাই।’
‘আমার ফৌজ যদি সেখানে কোন কারণে আটকা পড়ে যায়? জুলিয়ান জানতে চাইলেন। কিংবা আমার ফৌজের তুলনায় অধিক সংখ্যক ফৌজের সাথে যদি মোকাবেলা করতে হয় তাহলে আমার পরিণতি কী হবে?’
‘তোমাকে মন্দ পরিণতির সম্মুখীন হতে দেব না। মুসা বিন নুসাইর বললেন। ‘আমার ফৌজ সমুদ্রসৈকতে উপস্থিত থাকবে। আমি সংবাদ প্রেরণের এমন ব্যবস্থা করব যে, তোমার বাহিনী কোন প্রকার বিপদের সম্মুখীন হলে তৎক্ষণাৎ আমাকে অবহিত করা হবে এবং আমার ফৌজ তোমার সাহায্যার্থে সেখানে উপস্থিত হবে।’
***
জুলিয়ান ও আইপাস তৎক্ষণাৎ তাদের সম্মতি প্রকাশ করলেন। মুসা বিন নুসাইরের সাথে মিলে তারা আন্দালুসিয়ার সমুদ্র তীরবর্তী একটি এলাকায় আক্রমণের প্রান তৈরি করলেন। অতঃপর জুলিয়ান ও আউলাস সিউটার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলেন।
মুসা বিন নুসাইর তার কিছু সংখ্যক সৈন্যকে সেনাপতি আবু যুর’আ তুরাইফ বিন মালেক আল-মু’আফেরীর নেতৃত্বে পাঠিয়ে দিলেন। মুসা বিন নুসাইর তাকে বলে দিলেন, তিনি যেন সিউটার পার্শ্ববর্তী কোন অঞ্চলে পৌঁছে তাঁবু গেড়ে অপেক্ষা করেন। জুলিয়ান যখন তার সৈন্যবাহিনী আন্দালুসিয়া অভিমুখে পাঠাবে তখন তুরাইফ তার বাহিনীকে সিউটার উপকূলে এনে উপস্থিত করবে।