ভোগবাদী ও কায়েমী স্বার্থবাদীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সেনাবাহিনী বাদশাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তখন এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেয় রডারিক। অর্টিজার আস্থাভাজন সৈন্যদের সংখ্যা অনেক কম ছিল। তারা বিদ্রোহীদের সাথে বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারেনি। বিদ্রোহীরা বিজয়ী হলে সকল পাদ্রি মিলে রডারিককে বাদশাহ নিযুক্ত করে।
রডারিক বাদশাহ হওয়ার পর সর্বপ্রথম যে নির্দেশ জারি করে তা হল, অর্টিজাকে হত্যা করা হোক। অর্টিজার হত্যাকাণ্ড সম্পাদন হওয়ার পর পরই নেতৃবর্গ, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, শাহীখান্দানের লোকজন, কায়েমী স্বার্থবাদী ব্যক্তিবর্গ ও ভোগবাদী পাদ্রিরা পুনরায় ভোগ-বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দেয়।
মুসা বিন নুসাইর, আমি আপনাকে এই নিশ্চয়তা দিতে পারি যে, আপনি আন্দালুসিয়া আক্রমণ করলে, সেখানের জনসাধারণ অত্যাচারী ও বিলাসী বাদশাহ এবং তার জেনারেলদের পক্ষ ত্যাগ করবে। সৈন্যবাহিনীও বিগড়ে যেতে পারে। আপনার সেনাবাহিনী যদি শৌর্য-বীর্যের সাথে লড়াই করে তাহলে আন্দালুসিয়ার সৈন্যবাহিনী ময়দান ত্যাগ করতে বাধ্য হবে।’
জুলিয়ানের সর্বপ্রকার উৎসাহ প্রদান সত্ত্বেও মুসা বিন নুসাইর তাকে কোন ধরনের আশ্বাসবাণী শুনানো থেকে বিরত রইলেন।
***
চার-পাঁচ দিন পর হেনরি মুসা বিন নুসাইরের বার্তাবাহকের সাথে সিউটা থেকে তানজানিয়া এসে পৌঁছল। অন্যান্য মেহমানদের মতোই তাকে আদর আপ্যায়ন করা হল। অতঃপর তাকে মুসার নিকট পাঠিয়ে দেওয়া হল।
হেনরি জুলিয়ান থেকে এ কথা গোপন রেখেছিল যে, সে ফ্লোরিডাকে ভালোবাসে এবং তারা গোপনে একজন আরেকজনের সাথে মিলিত হতো। সে ফ্লোরিডার বিরহবেদনা সইতে না পেরে টলেডো চলে গিয়েছিল। অথচ জুলিয়ানের নিকট সে বলেছিল, সিউটায় তার মন হাঁপিয়ে উঠেছিল। তাই সে মনোরঞ্জনের জন্য টলেডো ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বের হয়েছিল।
মুসা বিন নুসাইরের নিকট সে স্বীকার করে যে, ফ্লোরিডার সাথে তার ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল। ফ্লোরিডার সাথে সাক্ষাতের জন্যই সে টলেডো ভ্রমণ করে। সেখানে কীভাবে তাদের উভয়ের দেখা-সাক্ষাৎ হয়, কীভাবে তারা পরস্পর মিলিত হয়, কীভাবে রডারিক ফ্লোরিডার শ্লীলতা হরণ করে–এসব ঘটনা সবিস্তারে মুসা বিন নুসাইরের নিকট বর্ণনা করে।
মুসা বিন নুসাইর হেনরিকে আনুষঙ্গিক আরো কয়েকটি বিষয়ে প্রশ্ন করেন। হেনরি যথাসম্ভব সকল প্রশ্নের উত্তর দেয়। প্রশ্ন করে করে মুসা বিন নুসাইর তার মনের সন্দেহ দূর করে নেন এবং হেনরিকে মেহমান খানায় পাঠিয়ে দেন। অতঃপর জুলিয়ানকে নিজের কাছে ডেকে পাঠান।
‘ভাই জুলিয়ান!’ মুসা বিন নুসাইর বললেন। ‘আমি তোমার প্রতিটি কথা এবং বন্ধুত্বের প্রস্তাবের ব্যাপারে গভীরভাবে চিন্তা করে দেখেছি, আমি আমার উপদেষ্টাবৃন্দের সাথেও সলাপরামর্শ করেছি। ভাই জুলিয়ান! আমি তোমার কথায় পূর্ণাঙ্গরূপে আস্থা স্থাপন করেছি, তবে আমি একা এভো বড় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারি না। তাছাড়া আন্দালুসিয়াও ছোটখাট কোন রাজ্য নয়। তার সৈন্যবাহিনীও কোন মামুলী বাহিনী নয়।
আমি খলীফার নির্দেশের অপেক্ষা করছি, আজই আমি খলীফার নিকট পয়গাম লেখে দামেস্কের উদ্দেশ্যে আমার বার্তাবাহক পাঠাচ্ছি। উত্তরের জন্য তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে। বার্তাবাহক যেন অত্যন্ত দ্রুত পৌঁছতে পারে, সে ব্যবস্থা করা হবে। তারপরও বার্তাবাহকের ফিরে আসতে প্রায় একমাস লেগে যাবে। তুমি এখন চলে যাও। পঁচিশ-ছাব্বিশ দিন পর এসো। আর না হয়, আমিই তোমাকে সংবাদ দিয়ে ডেকে পাঠাব।’
মুসা বিন নুসাইর জুলিয়ানকে বিদায় দিয়ে বার্তাবাহককে ডেকে আনেন। তিনি বার্তাবাহককে দিয়ে খলীফার নামে এক দীর্ঘ পয়গাম লেখান, যে পয়গামে তিনি জুলিয়ানের ঘটনার পূর্ণ বিবরণ তুলে ধরেন।
সে সময় খলীফা ছিলেন ওলিদ বিন আবদুল মালেক। তিনি প্রকৃত অর্থেই একজন মর্দেমুমিন ছিলেন। তাঁর একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান এই ছিল যে, কীভাবে ইসলামের পয়গাম পৃথিবীর সর্বত্র পৌঁছে দেওয়া যায়।
যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, সে সময় খলীফা ওলিদ বিন আবদুল মালেক হাজ্জাজ বিন ইউসুফের অনুরাধে মুহাম্মদ বিন কাসেমকে হিন্দুস্থান বিজয়ের জন্য পাঠিয়ে ছিলেন।
মুসা বিন নুসাইর জুলিয়ানের পূর্ণ ঘটনা বর্ণনা করার পর লেখেন :
‘ঘটনাচক্রে জুলিয়ান আজ এক বিরাট বৃক্ষের খণ্ডিত শাখার ন্যায় আমাদের করায়ত্ত হয়েছে। সম্মানিত খলীফার দরবারে আমি আমার ইচ্ছার কথা এভাবে প্রকাশ করছি, বহু দিন থেকেই আমার দৃষ্টি আন্দালুসিয়ার সীমান্ত অতিক্রম করার জন্য উন্মোখি হয়ে আছে। ইসলামের পয়গাম মিসর ও আফ্রিকার সমুদ্রসৈকতে এসে থমকে দাঁড়িয়েছে। আমি কয়েকবারই তানজানিয়ার সমুদ্রসৈকতে দাঁড়িয়ে আন্দালুসিয়ার দিকে তাকিয়ে থেকেছি। প্রতিবারই আমি সমুদ্রের বুক চিরে আন্দালুসিয়া আক্রমণ করার পরিকল্পনা এঁটেছি। এখন একজন খ্রিস্টান রাজা সাহায্যের জন্য হাত বাড়িয়েছে। তাই সকল দিক বিবেচনা করে আমাকে আন্দালুসিয়া আক্রমণ করার অনুমতি প্রদান করুন।
আমি আরেকটি দিকেও মহামান্য খলীফার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, তা হল আমার নিকট যে সৈন্যবাহিনী আছে, তাদের বেশিরভাগই বার্বার। বার্বার হিংস্র ও হানাহানী প্রিয় এক সম্প্রদায়। আমি তাদেরকে নিয়ম-শৃঙ্খলার অনুগত করেছি। কিন্তু তারা বেশি দিন শান্তিতে বসে থাকার লোক নয়। যুদ্ধ-বিগ্রহ এদের স্বভাবজাত বিষয়। তারা সর্বদা অবাধ্যতা ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য প্রস্তুত থাকে। দীর্ঘদিন তাদেরকে নিয়ম-শৃঙ্খলার অনুগত করে রাখা সম্ভব নয়। আর কিছু দিন তাদেরকে এমন নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে কর্মহীন করে আবদ্ধ রাখলে তারা নিজেরাই নিজেদের সাথে ঝগড়ায় লিপ্ত হয়ে পড়বে এবং নিয়ম-শৃঙ্খলার অবাধ্য হয়ে যাবে। এমনকি তারা ইসলামের ব্যাপারেও বিমুখ হয়ে যেতে পারে।