‘তোমার মেয়ে ফ্লোরিডা শুধু সৌন্দর্যের প্রতিমাই নয়, বুদ্ধিমতি এবং বাহাদুরও বটে। তাকে কোন সাধারণ ব্যক্তির হাতে তুলে দিও না; আমি তার তরবিয়তের ব্যাপারে ব্যক্তিগতভাবে আগ্রহ বোধ করছি।’
জুলিয়ান অনুগত গোলামের মতোই বললেন, ‘এটা আমার সৌভাগ্য। আমি কিছু দিনের জন্য ফ্লোরিডাকে আমার সাথে নিয়ে যেতে চাই।
‘না নিয়ে গেলেই ভালো হয়। রডারিক বলল।
‘তার মা খুব বেশি অসুস্থ। জুলিয়ান মিথ্যে বানিয়ে বললেন। তার মা’ই আমাকে পাঠিয়েছেন। তিনি বলেছেন, দু-একদিনের জন্য ফ্লোরিডাকে নিয়ে এসো। আমি তার মা’র আবেগে আঘাত দিতে পারি না। দু-একদিন পরই আমি মেয়েকে পাঠিয়ে দেব।’
রডারিক প্রশান্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘তাকে পাঠিয়ে দেবে? তাহলে নিয়ে যাও।
জুলিয়ান আরেকটি মিথ্যা কথা বললেন, ফ্লোরিডা বলেছে, সে খুব শীঘ্রই ফিরে আসতে চায়।’
‘তোমার মেয়ে অবশ্যই ফিরে আসতে চাইবে।’ রডারিক বলল। আচ্ছা জুলিয়ান! শুনেছি, তোমাদের এলাকায় উন্নত প্রজাতির বাজপাখি পাওয়া যায়? আমার একটি শিকারী বাজপাখি প্রয়োজন।’
‘হ্যাঁ, শাহানশাহে আন্দালুসিয়া! আমি আপনার জন্য এমন শিকারী বাজপাখি পাঠাবো, যা কখনও আপনি দেখেননি। সে শিকারের উপর এমনভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে যে, তাকে বাঁচার সুযোগ পর্যন্ত দেয় না।
জুলিয়ান ফ্লোরিডাকে সিউটা নিয়ে আসার পরের দিনই মুসা বিন নুসাইরের সাথে সাক্ষাতের জন্য বেরিয়ে পড়লেন।
***
মুসা বিন নুসাইর অত্যন্ত বিচক্ষণ ব্যক্তি ছিলেন। তিনি সর্বদা সতর্কতা অবলম্বনকে গুরুত্ব দিতেন। তিনি বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না যে, একজন খ্রিস্টানের পক্ষে কীভাবে সম্ভব মুসলমানদের মাধ্যমে আরেকজন খ্রিস্টানের উপর আক্রমণ করানো। তিনি ভাবছিলেন, এটা খ্রিস্টানদের কোন ষড়যন্ত্র নয় তো! তাই তিনি হুট করে জুলিয়ানকে কোন আশ্বাসও দিতে পারছিলেন না।
‘আপনি যদি আমার কথা বিশ্বাস না কর তাহলে আমি আমার কন্যা ফ্লোরিডাকে এখানে ডেকে আনছি, আপনি তাকে জিজ্ঞেস করে দেখুন। জুলিয়ান মুসা বিন নুসাইরকে বললেন।
‘আমি হেনরির সাথে কথা বলতে চাই।’ মুসা বললেন। আমার বার্তাবাহক তাকে নিয়ে আসবে। সে না আসা পর্যন্ত তুমি এবং তোমার সাথে আগত ব্যক্তিগণ আমার এখানে মেহমান হিসেবে থাকবে।’
হেনরিকে আনার জন্য তখনই একজন বার্তাবাহক পাঠিয়ে দেওয়া হল। এই অবকাশে জুলিয়ান মুসা বিন নুসাইরের নিকট আন্দালুসিয়া ও রডারিক সম্পর্কে এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব উপস্থাপন করলেন, যা আজ পর্যন্ত ইতিহাসের পাতায় সংরক্ষিত হয়ে আছে।
‘মুসা বিন নুসাইর!’ জুলিয়ান বললেন। রডারিকের প্রতি আমার এই আক্রোশ নতুন কোন বিষয় নয়। এক পুরনো শত্রুতার জের ধরে আমি তার প্রতি এই আক্রোশ পোষণ করে আসছি। আপনি হয়তো জানেন যে, এক সময় আন্দালুসিয়ার শাসন ক্ষমতা ছিল গোথ বংশের হাতে। সে সময় রডারিক আন্দালুসিয়ার সৈন্যবাহিনীর একজন জেনারেল ছিল। অর্টিজা নামক গোথবংশীয় এক ব্যক্তি তখন আন্দালুসিয়ার বাদশাহ ছিলেন। স্বভাবগতভাবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সৎ।
অর্টিজার ক্ষমতা গ্রহণের পূর্বে পাদ্রিরা ধর্মের ছত্রছায়ায় সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছিল। তারা বিলাসবহুল জীবন যাপন করত। গির্জাগুলো পাপপুরীতে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। সে সময় পোপের নির্দেশই ছিল শেষ কথা। পাদ্রিরী যা ইচ্ছা তাই করত। কারণ, তারা ছিল ধর্মীয় অনুসৃত ব্যক্তি। জনসাধারণ ও সৈন্যবাহিনী তাদেরকে সম্মান করত। স্বয়ং বাদশাহও তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলতে সাহস করতেন না।
সামাজিক পরিস্থিতি এই পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল যে, একদিকে সম্পদশালীরা সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছিল, আর অন্য দিকে সম্পদহীন ব্যক্তিরা কপর্দক শূন্য হতে হতে পথের ভিখারিতে পরিণত হচ্ছিল। প্রজা সাধারণ মূলত রাজবংশের দাসানুদাস ছিল। লোকদেরকে বেগার খাটানো হতো। তাদেরকে খুব সামান্য পারিশ্রমিক দেওয়া হতো। অতি সামান্য ও তুচ্ছ বিষয়ে প্রজাদের উপর নির্যাতন চালানো হত। বিভিন্ন কর ও টেক্স আদায় করতে করতেই জনগণের নাভিশ্বাস উঠত। তারা অনাহারে-অর্ধাহারে দিনাতিপাত করত। অপর দিকে শাহী কোষাগারের পরিধি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছিল। রাজবংশের লোকেরা আরাম-আয়েশ আর বিলাসিতার জীবন যাপন করছিল। এমনি পরিস্থিতিতে অর্টিজা শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করেন।
আমার স্ত্রী হলেন তাঁরই কন্যা। অর্টিজার অন্তরে ধর্মের প্রতি সম্মান ও জনসাধারণের প্রতি ভালোবাসা ছিল। তিনি ক্ষমতা গ্রহণ করার সাথে সাথে গির্জা ও। পাদ্রিদের প্রতি মনোনিবেশ করেন এবং গির্জাসমূহ থেকে পাপের পঙ্কিলতা বিদূরিত করেন। এরপর তিনি সে সকল বিত্তশালীদের প্রতি মনোনিবেশ করেন, যারা জনগণের রক্ত চুষে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছিল। অর্টিজা জনসাধারণের উপর থেকে ট্যাক্স তুলে নিয়ে বিত্তশালীদের উপর ট্যাক্স আরোপ করেন। সম্পদশালীদের সম্পদের হিসাব-নিকাশ করে তাদের উপর পৃথক পৃথকভাবে কর ধার্য করেন। ফলে জনসাধারণের অবস্থা ধীরে ধীরে উন্নত থেকে উন্নততর হতে থাকে।
কিন্তু ধর্মীয় স্বার্থবাদী এবং বিশাল-বিপুল সম্পদের অধিকারী কায়েমী স্বার্থবাদী ব্যক্তিরা কিছুতেই তা মেনে নিতে পারছিল না। তারা ভুখা নাজা জনসাধারণের রক্ত চুষে সম্পদের যে পাহাড় গড়ে তুলেছিল, সে সম্পদ পুনরায় তাদের হাতে ফিরিয়ে দিতে রাজি হল না। ভোগবাদী, স্বার্থপর পাদ্রিরা ধর্মের ধুয়া তুলে সেনাবাহিনীকে এই বলে অর্টিজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য ইন্ধন যোগাল যে, অর্টিজা ধর্মীয় ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে ধর্মীয় ব্যক্তিদেরকে তার গোলাম বানাতে চায়।