‘এই ঘোড়া তোমাদের নৌকার চেয়েও মূল্যবান। এটা তোমাদের হয়ে যাবে, আমাকে সিউটার সমুদ্রসৈকতে পৌঁছে দাও।’
‘আমরা নৌকার সামান্য মাঝি, ঘোড়া দিয়ে আমরা কী করব?’ মাঝিরা বলল। এমনিতেই আমরা পরিবার-পরিজন নিয়ে পেট ভরে দু’বেলা খেতে পাই না, ঘোড়াকে কোত্থেকে খাওয়াব?”
‘তোমরা ঘোড়াটি বিক্রি করেও তোমাদের পাওনা উসুল করে নিতে পার।
‘আমরা ঘোড়র দর-দাম সম্পর্কে কিছুই জানি না।’
‘তাহলে তোমরা আমাকে বিশ্বাস কর।’ হেনরি নিরাশ হয়ে বলল। সিউটা পৌঁছে আমি তোমাদের ভাড়া মিটিয়ে দেব এবং তোমাদেরকে পুরস্কৃত করব।’
মাঝিরা তার চেহারা-সুরত, লেবাস-পোশাক ও শাহীঘোড়া দেখে তাকে বড় কোন অফিসার মনে করছিল। তারা ঘোড়াসহ তাকে নৌকায় উঠিয়ে নিল।
মাঝিরা নোঙর খুলে পাল তোলে দিল। তীর-তীর করে নৌকা চলতে শুরু করল।
সমুদ্র পথের এই দূরত্ব ছিল মাত্র বার মাইল। নৌকা যখন সিউটার সমুদ্র বন্দরে এসে পৌঁছল তখন সূর্য অস্ত যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। হেনরি মাঝিদেরকে সাথে নিয়ে সোজা জুলিয়ানের মহলে গিয়ে উঠল। সে প্রহরীদের বলল,
‘কাউন্ট জুলিয়ানকে এখনই আমার আগমনের সংবাদ দাও। আমি টলেডো থেকে শাহজাদী ফ্লোরিডার অত্যন্ত জরুরী পয়গাম নিয়ে এসেছি।’
জুলিয়ান তৎক্ষণাৎ তাকে দরবারে ডেকে পাঠালেন। সে তার মেয়ের সংবাদ জানার জন্য অস্থির হয়ে ছিলেন।
‘তুমি ফ্রেডরিকের ছেলে হেনরি না?’ জুলিয়ান বললেন।
‘হ্যাঁ, কাউন্ট!’ হেনরি বলল।
‘তুমি কি টলেডো থেকে আসছ? বাবাকে কিছু না বলেই চলে গিয়েছিলে বুঝি?
‘হ্যাঁ, কাউন্ট! এখানে ভালো লাগছিল না, তাই আন্দালুসিয়া সফর করার উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়েছিলাম। সম্মানিত কাউন্ট! আমার হঠাৎ হারিয়ে যাওয়া, আর হঠাৎ আগমন করা আপনার জন্য কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। আমি যে পয়গাম নিয়ে এসেছি, তা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তবে প্রথমে ছোট্ট একটি আবেদন, আমি যে নৌকায় এসেছি, তার ভাড়া পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। মাঝি আমার সাথেই এসেছে। তাদের ভাড়া পরিশোধ করতে হবে। আমি তাদেরকে পুরস্কৃত করব বলে ওয়াদা করেছি।’
জুলিয়ান ভাড়া ও পুরস্কার উসুল করার নির্দেশ দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তার মেয়ে কী পয়গাম পাঠিয়েছে?
হেনরি ফ্লোরিডার পয়গাম শোনানের সাথে সাথে জুলিয়ান বিদ্যুতাড়িতের ন্যায় উঠে দাঁড়ালেন। তার শরীরের সমস্ত রক্ত চেহারায় আর চোখে জমা হতে লাগল। রাগে-দুঃখে অগ্নিশর্মা হয়ে তিনি কামরার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে দ্রুত পায়চারী করতে লাগলেন।
শাহজাদীর সাথে ঘটনাক্রমে আমার দেখা হয়েছিল। হেনরি বলল। সে আমাকে এ ঘটনা শুনালে আমি রডারিককে হত্যা করার জন্য প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু শাহজাদী আমাকে এই বলে বাধা দেয় যে, আমি রডারিক পর্যন্ত পৌঁছতে পারব না; বরং তার পূর্বেই ধরা পড়ে যাব। আমি সেখানের শাহী আস্তাবল থেকে ঘোড়া চুরি করে এখানে পৌঁছেছি।’
‘শাহজাদী ঠিকই বলেছে। জুলিয়ান বললেন। ঐ দুরাচার শয়তানকে হত্যা করা এতো সহজ নয়। আমি অবশ্যই এর প্রতিশোধ নেব। তুমি এখন যেতে পার।’
জুলিয়ান হলেন এই এলাকার বাদশাহ। তাই তিনি এমন একটি নাযুক বিষয়ে সামান্য একজন কর্মচারীর সামনে কোন প্রকার মন্তব্য প্রকাশ করা সমীচীন মনে করছিলেন না। তিনি হেনরিকে পুরস্কৃত করতে চাইলেন।
‘না, কাউন্ট! এই পুরস্কার আমি কোন সাফল্যের বিনিময়ে গ্রহণ করব? হেনরি বলল। আপনি আমাকে অনুমতি দিন, আমি আন্দালুসিয়া গিয়ে রডারিককে হত্যা করার সুযোগ তৈরি করে নিব।
***
জুলিয়ান অল্প সময়ের মধ্যে কিছু উপহার-উপঢৌকন নিয়ে টলেডো এসে উপস্থিত হলেন। তিনি রডারিকের সাথে এতোটাই আন্তরিকতার পরিচয় দিলেন যে, তাকে দেখে মনে হচ্ছিল, তার মেয়ের সাথে রডারিকের অশালীন আচরণ সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না। যে কেউ তাকে দেখলে ধারণা করবে, তিনি আন্দালুসিয়ার বাদশাহর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের জন্য শুভেচ্ছার সওগাত নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন।
বাদশাহ রডারিক যখন দেখল, জুলিয়ান কিছুই জানে না তখন সে জুলিয়ানের প্রতি অন্যান্য করদ-রাজাদের তুলনায় অনেক বেশি আতিথেয়তা ও সম্মান প্রদর্শন করল। রডারিক তার সম্মানে রাজকীয় ভোজের আয়োজন করল। ভোজসভায় গান-বাজনার ব্যবস্থাও করা হল। ফ্লোরিডা ভোজসভায় তার বাবার পাশেই বসা ছিল। সে রডারিকের আচরণ সম্পর্ক তার বাবাকে সব কিছু খুলে বলল। রডারিক তাকে যে ধমকি দিয়েছে সে কথাও বলল।
‘আমাদের আস্তাবলের প্রধান ফ্রেডরিকের ছেলে হেনরি আমাকে সব কিছু বলেছে।’ জুলিয়ান বললেন। আমি রডারিকের সামনে অজ্ঞ বনে বসে আছি। আমি তোমাকে ফিরিয়ে নিতে এসেছি। তার পর এমন প্রতিশোধ নেব যে, ওর বাদশাহী মাটির সাথে মিশে যাবে।
পরদিন বাদশাহ রডারিক জুলিয়ানের সাথে একান্ত বৈঠকে মিলিত হল। সে জুলিয়ানের সাথে সিউটার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সংক্রান্ত বিষয়ে মতবিনিময় করল। রডারিক জুলিয়ানকে জিজ্ঞেস করল, “ইতিমধ্যে নিশ্চয় মুসলমানরা সিউটা আক্রমণের সাহস করেনি?
‘না, তারা সিউটার দুর্ভেদ্য প্রাচীরের সাথে মাথা ঠোকরিয়ে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছে।’ জুলিয়ান বললেন। তারা বুঝতে পেরেছে যে, সিউটার উপর আন্দালুসিয়ার মতো দুর্বিনীত শক্তির ছায়া রয়েছে। আরব ও বার্বার মুসলমানরা সিউটার দিকে চোখ তুলে তাকাতেও সাহস করে না।’