আন্দালুসিয়ার ইতিহাস রচয়িতাদের সকলেই এ কথা লেখেছেন যে, ফ্লোরিডা রডারিকের কোন প্রলোভন বা হুমকির সামনে আত্মসমর্পণ করেনি। সে বারবার তার সতীত্ব আর কুমারীত্বের দোহায় দিচ্ছিল, কিন্তু ক্ষমতার দাপট আর মদের নেশা তখন রডারিককে হিংস্র পশু বানিয়ে দিয়েছিল, ফলে মোল বছর বয়স্কা এক অবলা মেয়ে তার সতীত্ব আর কুমারীত্ব রক্ষা করতে সক্ষম হল না।
***
রাতের অর্ধপ্রহর অতিবাহিত হয়েছে। নিঝুম নিশুতি রাত। কোথাও কোন সারা-শব্দ নেই। ঘন বৃক্ষরাজিতে আচ্ছাদিত অন্ধকার এক জায়গা দিয়ে দেয়াল টপকে হেনরি বাগানে প্রবেশ করল। এর আগেও সে এই জায়গা দিয়ে দুইবার বাগানে প্রবেশ করেছে। সে দেয়াল ঘেঁষে মাথা নিচু করে সেই স্থানে এসে পৌঁছল যেখানে ফ্লোরিডার সাথে তার সাক্ষাৎ হত। ফ্লোরিডা এখনও এসে পৌঁছেনি।
তাকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। সে দেখতে পেল, একটি ছায়া ধীরে ধীরে তার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আরো কাছে আসার পর স্পষ্ট হল, ছায়াটি একটি মেয়ের। হেনরি বরাবরের ন্যায় দুই-তিন পা অগ্রসর হয়ে ফ্লোরিডাকে লক্ষ্য করে দুই বাহু প্রসারিত করে ধরল। কিন্তু ফ্লোরিডাকে আজ একেবারেই স্থবির ও নিস্তেজ মনে হচ্ছিল। তার মাঝে প্রেমাস্পদের সাথে অভিসারের কোন উত্তেজনা ছিল না। সে হেনরির বাহু বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পরিবর্তে তার হাত সরিয়ে দিলো। তারপর একদিকে ঝুঁকে ঘাসের উপর বসে পড়ল। তাকে খুব অসুস্থ দেখাচ্ছিল।
‘কি হয়েছে, ফ্লোরিডা?’ হেনরি তার পাশে বসতে বসতে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।
‘আমার থেকে দূরে থাক, হেনরি!’ ফ্লোরিডা কাঁদতে কাঁদতে বলল। আমার এই অপবিত্র দেহ তুমি ছোঁয়ো না। এখন আমি আর তোমার যোগ্য নই। আমি আমার আত্মমর্যাদাশীল, বাহাদুর বাবাকে মুখ দেখাতে পারব না। এখন আমি আমার নিজেকেই অভিসম্পাত করছি।’
‘ফ্লোরা কি হয়েছে, বলবে তো?’ হেনরি অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করল।
ফ্লোরিডা তাকে পুরো ঘটনা শুনিয়ে বলল, ‘আমার সতীত্ব ছিল আমার সবচেয়ে বড় সম্পদ।’ ফ্লোরিডা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল আর বলছিল। আমি নিজেকে কখনও শাহজাদী মনে করিনি। যদি আমার রানী হওয়ার ইচ্ছা থাকত তাহলে আমার বাবার অধীন এক কর্মচারীর ছেলেকে আমি কখনই ভালোবাসতাম না।’
‘ফ্লোরা!’ হেনরি উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। সে তার কাপড়ের নিচে রাখা খঞ্জর বের করে বলল। আমি এই চরিত্রহীন বাদশাহকে হত্যা করে তোমার ইজ্জতের প্রতিশোধ নেব। তাকে হত্যা করে মহল থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করব। যদি ধরা পড়ি তাহলেও কোন পরোয়া করি না। তোমার ইজ্জতের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আমি হাসি মুখে জীবন দিতেও রাজি আছি।’
‘না, হেনরি, না।’ ফ্লোরিডা দাঁড়িয়ে তার সামনে দুই হাত প্রসারিত করে বলল। “তুমি ঐ শয়তানের কাছেও পৌঁছতে পারবে না। তার আগেই ধরা পড়ে যাবে। আমি তোমাকে লক্ষ্যহীন মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারি না। তুমি এক কাজ কর, সকালে শহরের ফটক খোলার সাথে সাথে শহর থেকে বের হয়ে পড়বে। যে কোন অযুহাতেই হোক সবচেয়ে উত্তম ঘোড়া নিবে। তারপর যতটা দ্রুত সম্ভব সিউটা পৌঁছে আমার বাবার কাছে পুরো ঘটনা খুলে বলবে।
তাঁকে বলবে, তিনি যেন কোন বাহানায় আমাকে এখান থেকে নিয়ে যান। রডারিককে যেন কিছুতেই বুঝতে না দেন যে, তিনি এ ঘটনা সম্পর্কে জানেন। তিনি যদি রডারিকের সামনে সামান্য অসন্তুষ্টিও প্রকাশ করেন তাহলে এই অসচ্চরিত্র বাদশাহ তাকে খুন করে ফেলবে। আর আজীবনের জন্য আমাকে তার মহলে বন্দী করে রাখবে। রডারিক আমাকে অত্যন্ত ভয়াবহ ধমকি দিয়েছে। বাবাকে খুব ভালোভাবে বুঝিয়ে বলবে। অন্যথায় সিউটা তাঁর হাতছাড়া হয়ে যাবে। আর আমাদের পরিবারের পরিণতি হবে খুবই ভয়ঙ্কর।
***
ভোর হতেই হেনরি আস্তাবলের সেরা ঘোড়ার পিঠে জিন লাগিয়ে নিল। প্রতিদিনের রুটিনওয়ার্ক হিসেবে ঘোড়ার পরিচর্যার অযুহাতে সে দুর্গ থেকে বের হয়ে এলো।
শহর রক্ষা প্রাচীরের ফটক কিছুক্ষণ হল খুলে দেওয়া হয়েছে। দুর্গ থেকে বের হয়েই সে ঘোড়ার গতি বাড়িয়ে দিল। যত দ্রুত সম্ভব তাকে এখন জেলেটার পৌঁছতে হবে। সেখান থেকে জাহাজ ধরে সমুদ্র পথে সিউটা যেতে হবে।
টলেডো থেকে জেত্রেলটার দূরত্ব হল পাঁচশ মাইল। একটি মাত্র ঘোড়া নিয়ে এই দূরত্ব অতিক্রম করা একেবারেই অসম্ভব। হেনরি ভাবল, তার ফিরে আসতে দেরী হচ্ছে দেখে, দুর্গ থেকে তার খুঁজে লোকজন বের হয়ে পড়তে পারে। তাই সে বিদ্যুৎগতিতে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। বেশ কিছু দূর অগ্রসর হয়ে সে একটি নদীর কিনারে ঘোড়া থামিয়ে তাকে পানি পান করাল। তারপর পুনরায় সফর শুরু করল।
সে অবিরাম ছুটে চলছিল। রাতের বেলাও সফর অব্যাহত রাখত। খুব অল্প সময়ের জন্য আরাম করত। আর বেশির ভাগ সময়ই সফর করত। বিরামহীনভাবে চলতে চলতে সে চারদিনে পাঁচশ মাইলের দূরত্ব অতিক্রম করে জেলেটার বন্দরে এসে পৌঁছল।
জেলেটার সমুদ্র বন্দর। সিউটা যাওয়ার জন্য কোন জাহাজই তখন তৈরী নেই। দুই-তিন দিনের মধ্যে কোন জাহাজ সিউটার উদ্দেশ্যে রওনাও হবে না। একটি পাল তোলা নৌকা নদীর পারে নোঙর করা ছিল। নৌকার মাঝি-মাল্লারা একা হেনরিকে পার করে দেওয়ার জন্য এতো বেশি পয়সা চাচ্ছিল যে, হেনরির কাছে এই পরিমাণ পয়সা ছিল না। হেনরি নৌকার মাঝিদের বলল,