সেই অঞ্চলের তিন বিদ্রোহী নেতাকে হত্যা করে ঐদিন সন্ধ্যায় রডারিক ফিরে এলো। দীর্ঘ সফরের ক্লান্তি আর বিদ্রোহ দমনের আনন্দ তার মনে এক মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল।
বিদ্রোহ দমনের আনন্দে রডারিক সন্ধ্যার পর শরাবের আসর জমিয়ে বসল। সে আনন্দ আর উল্লাসে ফেটে পড়ল। বুঝতে পারছিল না, আনন্দের এই মুহূর্ত সে কীভাবে উদ্যাপন করবে!
রাজা-বাদশাহরা আনন্দ-ফুর্তির সময় মদ আর নারী নিয়েই মেতে থাকতে পছন্দ করে। রডারিকের শাহীমহলেও এই দুটি বস্তুর কোন অভাব ছিল না। শরাবের আসরে দু-একজন দরবারীও রডারিকের সাথে নিজেদের পারঙ্গমত প্রদর্শন করছিল।
সুশ্রী ও চমৎকার দেহের অধিকারিনী একটি অল্পবয়স্কা মেয়ে রডারিকের পানপাত্র ভরে দিচ্ছিল। রডারিক মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, “কোন ফুল আছে, ফুল?
তারপর সামন্য সময়ের জন্য রডারিকের কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠল। সে বলল, “না, আজ আমার প্রয়োজন কোন কলির বা আধফুটা কলির।’
একজন দরবারী মুচকি হেসে বলল, এই তো সেই ফুল–যা শাহানশাহে আন্দালুসিয়ার নিদমহলে সুরভি ছড়িয়ে থাকে।’
‘না, আজ কোন নতুন কলি চাই। রডারিক নেশার ঘোরে বলে উঠল।
সে সামান্য সময়ের জন্য কি যেন চিন্তা করে চুটকী বাজিয়ে বলল। “হা… হা… পেয়েছি, ফ্লোরিডা… জুলিয়ানের মেয়ে ফ্লোরিডা…।’
‘শাহানশাহে আন্দালুসিয়া! একজন উপদেষ্টা বলে উঠল। বাহির থেকে আসা শাহজাদীগণ আমাদের নিকট পবিত্র আমানত। তারা এখানে আদব-আখলাক শেখার জন্য এসেছে। আজ পর্যন্ত কোন শাহজাদীর সাথেই কোন প্রকার অভদ্র আচরণ করা হয়নি। সুতরাং এই রেওয়াজ যেন নষ্ট না করা হয়।
‘আমি তাকে আন্দালুসিয়ার রানী বানাব। নেশার ঘোরে রডারিকের কথা জড়িয়ে আসছিল। তোমরা সকলে চলে যাও, আর ফ্লোরিডাকে এখানে পাঠিয়ে দাও।
‘মহামান্য শাহানশা!’ সেই উপদেষ্টা আবার বলল। “বিপদ সম্পর্কে আপনাকে সতর্ক করা আমার কর্তব্য। এই কর্তব্য আদায়ে আমাকে জীবন দিতে হলেও আমি রাজী আছি। হয়তো আপনারই তলোয়ার দেহ থেকে আমার গর্দান আলাদা করে ফেলবে। তবুও আমার আত্মা এই মনে করে প্রশান্তি লাভ করবে যে, আমি আমার কর্তব্য পলনে অবহেলা করেনি।
‘কিসের বিপদ?’ রডারিক তাচ্ছিল্যের সুরে বলল। ‘জুলিয়ানের পক্ষ থেকে আমার কী এমন বিপদ হতে পারে? প্রথম কথা হল, তার মেয়ে ফ্লোরিডা শাহানশাহে আন্দালুসিয়ার নিদমহলে রাত্রি যাপন করাকে নিজের জন্য বিরাট সম্মান মনে করবে। দ্বিতীয় কথা, সে যদি আমাকে গ্রহণ না করে এবং তার বাবার কাছে অভিযোগ করে তাহলে জুলিয়ান আমার কী-বা ক্ষতি করতে পারবে।
সে তো মাত্র দুই ইঞ্চি জমিনের মালিক। আমাদের বিশজন শাহসওয়ারের সাথে লড়াই করার ক্ষমতাও সে রাখে না। আমরাই তার শক্তি। অবশ্য সে আরব আর বাবার বাহিনীকে সিউটা অতিক্রম করে আন্দালুসিয়া আক্রমণ করতে দিচ্ছে না। কিন্তু তার একমাত্র কারণ হল, তার পিঠে আমাদের হাত রয়েছে। আমরা যদি তার উপর থেকে আমাদের হাত সরিয়ে নেই তাহলে বার্বার মুসলমানরা তার দুর্গের একেকটি ইট-সুরকি পর্যন্ত খুলে নিবে, আর তার দুই মেয়েকে দাসী বানিয়ে নিয়ে যাবে।
‘আমি যদি কিছু সময়ের জন্য তার মেয়েকে আমার নিদমহলে ডেকে আনি তাহলে তো তার খুশী হওয়া উচিত। তাছাড়া আমি তার মেয়েকে আমার রানীও বানাতে পারি।’
‘মহামান্য শাহানশা!’ সেই উপদেষ্টা পুনরায় বলল। আমি শুধু এতটুকুই বলতে পারি যে, আমাদের উচিত অন্যকে বন্ধু বানানো। বন্ধুকে শত্রু বানানো কিছুতেই ঠিক হবে না।’
‘তুমি নির্বোধের মতো কথা বলছ।’ রডারিক হুঙ্কার ছেড়ে বলল। এখন যাও, ফ্লোরিডাকে এখানে পাঠিয়ে দাও।
ক্ষমতার দম্ভ ও রাজত্বের গরিমা, আর শরাবের নেশা ও নারীর লিলা রডারিককে উন্মাদ বানিয়ে দিয়েছিল। কোন কিছুই সে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করতে পারছিল না।
কিছুক্ষণ পর ফ্লোরিডা তার কামরায় এসে উপস্থিত হল। তার চেহারায় ছিল আনন্দের উচ্ছ্বাস। ছোট মেয়েকে বাবা ডাকলে সে যেমন আনন্দে উল্লসিত হয়ে বাবার কাছে দৌড়ে যায়, ফ্লোরিডাও শাহানশাহে আন্দালুসিয়ার আহ্বানকে নিজের জন্য এক অনাকাক্ষিত সম্মান মনে করে উত্যু হয়ে ছুটে এসেছিল। কামরায় প্রবেশ করতেই রডারিক তাকে মজবুত বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে নেয়।
ফ্লোরিডা এমন পরিস্থিতির জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না। সে রডারিকের কুমতলব বুঝতে পেরে নিজেকে মুক্ত করার জন্য অনেক চেষ্টা করে, কিন্তু চরিত্রহীন উন্মাদ রডারিকের পেশীবহুল বাহুর শক্ত বেষ্টনী থেকে মুক্ত হওয়া তার পক্ষে ছিল একেবারেই অসম্ভব। রডারিকের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য সে অনেক কান্নাকাটি করল।
রডারিকের ধারণাও ছিল না যে, কোন মেয়ে তাকে এমনি তাচ্ছিল্যের সাথে প্রত্যাখ্যান করতে পারে। রডারিক তাকে রানী বানানোর লোভ দেখাল। কিন্তু সে সতীত্ব হারিয়ে রানী হতে রাজি হল না।
রডারিক তাকে ভয় দেখাল, সে যদি তার প্রস্তাবে রাজি না হয় তাহলে সিউটার উপর আক্রমণ করা হবে এবং তার বাবা-মা ও গোটা পরিবারকে টলেডোর অলিগলিতে ভিক্ষা চাইতে বাধ্য করা হবে।
ফ্লোরিডা রডারিককে বলল, ‘আসমান-জমিন জ্বালিয়ে ভস্ম করে দাও, তবুও আমি আমার সতীত্ব, আমার কুমারীত্ব বিসর্জন দেব না।’