সেখানে পৌঁছে সে শাহী আস্তাবলে উপস্থিত হয়ে সেখানের দায়িত্বশীল অফিসারের নিকট চাকরির দরখাস্ত পেশ করল। অফিসার ঠাট্টার ছলে তার পরীক্ষা নেওয়ার জন্য একটি অত্যন্ত বেয়াড়া ঘোড়ার দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ‘চাকরি চাচ্ছ? ঠিক আছে, তাহলে এই ঘোড়ায় সওয়ারী করে দেখাও।’
ঘোড়াটি ছিল অত্যন্ত বেয়াড়া, সহজে কারো বশ্যতা স্বীকার করত না। হেনরি নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ঘোড়র দিকে এগিয়ে গেল। সে অল্প সময়ের মধ্যে জিন লাগিয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসল। আস্তাবলের কর্মচারীরা এসে জড় হতে লাগল। তারা হেনরির ঘোড়া থেকে পড়ে যাওয়ার দৃশ্যটি উপভোগ করার জন্য কৌতূহলী চোখে অপেক্ষা করতে লাগল।
দেখতে দেখতে ঘোড়া অবাধ্য হয়ে উঠল। সওয়ারীর বশ্যতা স্বীকার করতে সে মোটেই প্রস্তুত নয়। কিন্তু হেনরি হল পাকা ঘোড়সওয়ার। অল্পক্ষণের মধ্যেই সে এই অবাধ্য, বেয়াড়া ঘোড়াকে তার বশে নিয়ে এলো। সে দ্রুতবেগে ময়দানের দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিয়ে একের পর এক ব্যারিকেট টপকে যেতে লাগল।
যারা তামাশা দেখার জন্য জড় হয়েছিল তারা অভিভূতের ন্যায় ছুটন্ত ঘোড়ার দিকে চেয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে হেনরি তীরন্দাজী ও বর্শা নিক্ষেপের পারঙ্গমতা প্রদর্শন করল। ফলে সে আস্তাবলে ভালো একটি চাকরি পেয়ে গেল। হেনরি শুধু চাকরি চাচ্ছিল না; সে ফ্লোরিডার সাথে দেখা করতে চাচ্ছিল। অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই সে জেনে নিল, ফ্লোরিডা কোথায় থাকে।
ফ্লোরিডার সাথে দেখা করতে তাকে খুব বেশি বেগ পেতে হল না। একদিন পাঁচ-ছয়জন শাহজাদী ঘোড়ায় চড়ে বেড়ানোর জন্য আস্তাবলে এলো। তাদের মাঝে ফ্লোরিডাও ছিল। ফ্লোরিডার মতো এ সকল শাহজাদীরাও শাহী শিষ্টাচার, আদব-কায়দা ও বাদশাহী চাল-চলনে প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য বিভিন্ন রাজ্য থেকে এসেছিল। ঘোড়সওয়ারীও তাদের প্রশিক্ষণের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
ফ্লোরিডা হেনরিকে দেখে অবাক হয়ে গেল। সে সোজা হেনরির নিকট এসে জিজ্ঞেস করল, “তোমার নাম কি? সে স্বাভাবিক আওয়াজেই জিজ্ঞেস করল, যেমনিভাবে শাহজাদীগণ অন্যান্য কর্মচারীদের নাম জিজ্ঞেস করে থাকে। আওয়াজের মধ্যে যেন তার অস্থিরতা প্রকাশ না পায়, সেদিকে তার খেয়াল ছিল।
‘আগাস্টা।’ হেনরি তার ছদ্মনাম বলল। এখানে সে সকলের নিকট এই নামই বলেছিল।
‘কোথাও যেন আমি তোমাকে দেখেছি।’ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ফ্লোরিডা বলল।
হয়তো দেখেছেন, আমি অনেক জায়গাতেই থেকেছি।’ হেনরি আত্মসংবরণ করে বিনীতস্বরে বলল।
অন্যান্য শাহজাদীরাও হাসতে হাসতে তাদের পাশে এসে জড় হল।
‘আস্তাবলে তুমি কি কাজ কর?’ ফ্লোরিডা জিজ্ঞেস করল।
শাহজাদী! এ বহুত আচ্ছা শাহসওয়ার।’ আস্তাবলের অফিসার নিকটেই দাঁড়িয়ে ছিল। সে শাহজাদীদের সাথে কথা বলার সুযোগ খেজছিল, এবার মওকা পেয়ে বলে উঠল।
‘আজ একেই আমাদের সাথে পাঠিয়ে দিন। আমি দেখতে চাই সে কত বড় শাহসওয়ার।’ ফ্লোরিডা অফিসারকে লক্ষ্য করে বলল।
অফিসার হেনরিকে তাদের সাথে পাঠিয়ে দিল। শাহীমহল থেকে বের হয়ে ফ্লোরিডা সঙ্গী শাহজাদীদের বলল, আমি এই শাহসওয়ারের সাথে ঘোড়া দৌড়িয়ে দেখতে চাই, ঘোড়দৌড়ে সে কতটা দক্ষ।’
কিছুক্ষণের মধ্যেই ফ্লোরিডা ও হেনরির ঘোড়া ঊর্ধ্বশ্বাসে পাশা-পাশি ছুটতে লাগল। তারা সবুজ পাহাড়ের ঢাল বেয়ে বহুদূর এগিয়ে গেল। যখন তারা ফিরে এলো তখন নিজেদের সব কথাই তারা বলে নিয়েছিল। হেনরি ফ্লোরিডাকে বলল, সে কাউকে কিছু না বলেই সিউটা থেকে চলে এসেছে।
‘এখনই ফিরে যাও। ফ্লোরিডা উৎকণ্ঠার সাথে বলে উঠল। আব্বা যদি জানতে পারেন, তুমি এখানে তাহলে তিনি প্রথম সন্দেহ এটাই করবেন যে, তুমি আমার জন্যই এখানে এসেছ। সিউটার শাহীচাকরি ছেড়ে এতদূর এসে চাকরি করার অন্য কোন অযুহাত দাঁড় করিয়ে তুমি কাউকেই আশ্বস্ত করতে পারবে না।’
‘আরো কয়েকটা দিন থাকতে দাও ফ্লোরা!’ হেনরি আবেগভরা কণ্ঠে বলল। দু-একবার তোমার সাথে সাক্ষাতের সুযোগ করে দাও। তারপর আমি চলে যাব। গিয়ে বাবাকে বলব, সিউটায় থেকে থেকে হাপিয়ে উঠে ছিলাম, তাই কয়েক দিনের জন্য আন্দালুসিয়া থেকে ঘুরে এলাম।’
***
শাহীমহলের চতুপাশে ঘন বৃক্ষরাজির বাগান। গোটা বাগান জোড়ে ফল আর ফুল বৃক্ষের সমাহার। কোন কোন জায়গা পত্র-পুস্পে একেবারে আচ্ছাদিত হয়ে আছে। ফ্লোরিডা হেনরিকে এমনি একটি জায়গার কথা বলল। সেখানে পৌঁছার রাস্তাও দেখিয়ে দিল। তবে সতর্ক করে দিল যে, অর্ধেক রাতের পরই শুধু এখানে আসা সম্ভব, অন্যথায় টহলদার সিপাহীদের হাতে ধরা পড়তে হবে।
হেনরি সব বিপদ উপেক্ষা করে পত্র-গুল্মে আচ্ছাদিত বাগানের সেই গোপনস্থানে একে একে দুইবার এসে ফ্লোরিডার সাথে সাক্ষাৎ করল। ফ্লোরিডাকেও এখানে আসার জন্য অনেক সতর্কতা অবলম্বন করতে হতো।
শাহীরেওয়াজ শেখার জন্য যে সকল শাহজাদী এখানে আসত সব সময় তাদেরকে চোখে চোখে রাখা হত। তা সত্ত্বেও ফ্লোরিডা প্রহরীদের চোখে ফাঁকি দিয়ে গভীর রাতে তার কামরা থেকে বের হয়ে পা টিপে টিপে বাগানে এসে উপস্থিত হতো।
দ্বিতীয়বার সাক্ষাতের সময় ফ্লোরিডা হেনরিকে তিন রাত পর দেখা করতে বলল।
হেনরির যেদিন বাগানে আসার কথা সে দিনই রডারিক চার-পাঁচ দিনের সফর শেষে শাহীমহলে ফিরে এলো। আন্দালুসিয়ার দূরবর্তী কয়েকটি অঞ্চলে বিদ্রোহীরা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল। বিদ্রোহ দমনের জন্য রডারিক সেখানে গিয়েছিল।