শাহজাদী ফ্লোরিডার নির্দেশ শোনামাত্র হেনরি দৌড়ে তার ঘোড়ার নিকট চলে এলো। সে ফ্লোরিডাকে নিচে নামানোর জন্য ঘোড়ার জিনের সাথে লাগানো রেকাবে হাত রাখল। কিন্তু ফ্লোরিডা তার বাহু প্রসারিত করে হেনরির গলা জড়িয়ে ধরে ঝুলে পড়ল।
হেনরি তাকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে মাটিতে নামিয়ে দিয়ে পিছে সরে আসতে চাইল। কিন্তু শাহজাদী তাকে নিজ বাহুবন্ধন থেকে বের হতে দিল না। সে হেনরিকে বলল, “চলে যেয়ো না হেনরি, তোমাকে আমার ভালো লাগে। অনেক ভালো লাগে।’
শাহজাদী, আমি তোমার সামান্য এক নওকরের ছেলে।’ হেনরি ভয়ে ভয়ে বলল। কাউন্ট জুলিয়ান যদি জানতে পারেন…।’
হেনরির কথা শেষ না হতেই ফ্লোরিডা বলে উঠল, ‘আমাকে ভুল বোঝ না হেনরি, আমি অবশ্যই মেয়েমানুষ; কিন্তু আমার স্বভাব অন্যান্য মেয়েদের মতো নয়। আমি শুধুমাত্র তোমার দেহ চাই না। আমি চাই এমন ভালোবাসা, যে ভালোবাসা অন্তরের মাটিতে অঙ্কুরিত হয়, আর তার দীপ্তি অন্তরলোকে ছড়িয়ে পড়ে। তুমি কি এমন ভালোবাসা সম্পর্কে অবগত নও?
“না, শাহজাদী।’ হেনরি স্বসংকোচে উত্তর দিল।
‘আমাকে শাহজাদী বলো না। আমি তোমাকে হুকুম দিচ্ছি না যে, তুমি আমাকে ভালোবাস। আমার শুধু এতটুকু অনুরোধ, আমাকে ফ্লোরা বলে ডেকো।
***
এই ঘটনার পর অনেক দিন অতিবাহিত হয়ে গেছে। হেনরি এখন শাহজাদীকে ফ্লোরা বলেই ডাকে। সবার সামনে হেনরি শাহজাদীর গোলাম হয়েই থাকে; কিন্তু দুর্গ থেকে বের হয়ে দূরে কোথাও গেলে সে হয়ে উঠে শাহজাদীর মনের মানুষ; প্রাণের পুরুষ।
ফ্লোরিডা প্রথম দিন হেনরিকে বলেছিল, আমি শুধুমাত্র তোমার দেহ চাই না, আমি চাই সত্যিকার ভালোবাসা; চাই একটা মনের মতো মন।
ফ্লোরিডা তার কথা রেখেছিল। হেনরির প্রতি তার ভালোবাসা শুধু দেহসর্বস্ব ছিল না। সে দেহ-মন দিয়ে একান্তরূপে হেনরিকে ভালোবেসে ছিল। তার ভালোবাসার বীজ অন্তরের মটিতে অঙ্কুরিত হয়ে ছিল, আর তার শাখা-প্রশাখা অন্তরলোকে ছড়িয়ে পড়েছিল।
হেনরির সরাসরি তত্ত্বাবধানে ফ্লোরিডা শাহসওয়ারী, তীরন্দাজী ও অসি চালনার প্রশিক্ষণ নিতে লাগল। ফ্লোরিডার বাবা-মার মনে এ ব্যাপারে সামান্যতম সন্দেহও জন্ম নেয়নি যে, তাদের মেয়ে তার জীবনসাথী খুঁজে পেয়েছে।
ফ্লোরিডা ও হেনরি কখনও এ কথা চিন্তাও করেনি যে, তাদের বিয়ে হওয়া সম্ভব নয়। তারা ভেবেও দেখেনি যে, জুলিয়ান কখনই মখমলের চাদরের ছিন্ন অংশে চটের জোড়া লাগাবেন না।
এসব কিছু চিন্তা করা তো দূরের কথা, তারা প্রেমের নেশায় আর আবেগের টানে এতটাই মগ্ন হয়ে গিয়েছিল যে, তারা শুধু নিজেদের অবস্থানের কথাই ভুলে যায়নি; বরং গোটা পৃথিবী সম্পর্কেই বেখবর হয়ে পড়েছিল।
এমনি করেই সময় বয়ে চলছিল। দেখতে দেখতে দু’টি বছর অতিবাহিত হয়ে গেল। একদিন ফ্লোরিডার মা ফ্লোরিডাকে কাছে ডেকে বললেন,
‘তোমার বাবা তোমাকে টলেডো নিয়ে যাবেন। আন্দালুসিয়ার বাদশাহ রডারিকের শাহীমহলে তোমাকে এক বছর থাকতে হবে।’
‘কেন? ফ্লোরিডা তার মাকে জিজ্ঞেস করল।
‘কী আশ্চর্য! তার মা বললেন। “তুমি কি জান না, শাহীখান্দানের মেয়েদেরকে শাহী আচার-আচরণ, আর শিষ্টাচার শিখার জন্য সেখানে গিয়ে থাকতে হয়?
‘আমি কি গ্রাম্য বুদ্ধ নাকি যে, শাহী আদব-কায়দা সম্পর্কে কিছুই জানি না।’ ফ্লোরিডা বলল। আমার মাঝে কিসের অভাব দেখেছেন আপনি? আমি সেখানে যাব না। সেখানের অনেক অপ্রীতিকর কথা আমি শুনেছি। সেখানে যে ধরনের আদব-কায়দা, আর শিষ্টাচার শিক্ষা দেওয়া হয়, তার অনেক কাহিনীই আমার জানা আছে।
মা অনেক বুঝালেন, কিন্তু ফ্লোরিডা গোঁ ধরে রইল। তার একই কথা, এ সকল বাদশাহদের কোন চরিত্র নেই। তাদের কোন আদর্শ নেই। অবশেষে তার বাবা যখন তাকে অনেকটা আদেশের সুরে আন্দালুসিয়া যেতে বললেন, তখন সেই আদেশ উপেক্ষা করার সাহস তার হল না। সে ভালো করেই জানত, তার বাবা কতটা নির্দয়, আর পাষাণ।
জুলিয়ান ও তার স্ত্রী ফ্লোরিডাকে সাথে নিয়ে আন্দালুসিয়ার রাজধানী টলেডোর উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। সেখানে কিছুদিন অবস্থান করার পর তারা ফ্লোরিডাকে রডারিকের শাহীমহলে রেখে সিউটা ফিরে এলেন।
টলেডো অবস্থানকালে একদিন তারা রডারিকের সাথে ফ্লোরিডার পরিচয় করিয়ে দেন। রডারিক ফ্লোরিডার উপচে পড়া যৌবন, আর চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য দেখে অভিভূত হয়ে পড়ল। সে অবচেতন মনে বলে উঠল, বাহ! কী সুন্দর! তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
‘জুলিয়ান, তোমার এই মেয়েকে কোন নামমাত্র শাহজাদার সাথে বিয়ে দিয়ে ওর জীবনটা নষ্ট করে দিও না।
‘এ আমার মেয়ে নয়; আমার ছেলে। জুলিয়ান মুচকি হেসে বললেন।
এমনি আরো অনেক কথার পর ফ্লোরিডাকে রডারিকের শাহীমহলে রেখে যখন তার বাবা-মা চলে আসছিলেন তখন তাদের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েছিল।
***
ফ্লোরিডা টলেডো গেছে আট-দশ দিন হয়। ইতিমধ্যে তার বাবা-মা টলেডো থেকে সিউটা ফিরে এসেছেন।
একদিন হেনরির বাবা জুলিয়ানের নিকট এসে বলল, হেনরিকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’
জুলিয়ানের নির্দেশে হেনরির খুঁজে পাহাড়-জঙ্গল, মরুভূমি সবত্র চষে ফেলা হল, কিন্তু কোথাও তার কোন হদিস মিলল না।
সিউটায় থাকলে তো তাকে পাওয়া যাবে? সে সিউটার সীমানা পেরিয়ে কয়েক দিনের কষ্টকর সফর শেষে টলেডো চরে গিয়েছিল। ফ্লোরিডার বিরহবেদনা সে সইতে পারছিল না। তাই পালিয়ে টলেডো চলে গিয়েছিল।