‘তোমার মেয়ে এখন কোথায়? মুসা বিন নুসাইর জানতে চাইলেন।
‘আমি তাকে আন্দালুসিয়ার রাজধানী টলেডো থেকে নিয়ে এসেছি। সে এখন সিউটাতে আছে। আপনি ইচ্ছে করলে তাকে এখানে ডেকে এনে জিজ্ঞেস করতে পারেন।
মুসা বিন নুসাইর! আমি আমার বেইজ্জতীর প্রতিশোধ নিতে চাই। আর এর একমাত্র রাস্তা হল, রডারিককে হত্যা করা। কিন্তু তা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। কারণ সে সব সময় দেহরক্ষীদের নিচ্ছিদ্র বেষ্টনীর মধ্যে থাকে। একা কখনই বাইরে বের হয় না।
এজন্য বিকল্প যে চিন্তা নিয়ে আমি আপনার নিকট এসেছি, তা হল আপনি আন্দালুসিয়ার উপর আক্রমণ করবেন। আমি আপনাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করব। তবে আমি দৃশ্যপটে উপস্থিত হব না।
আন্দালুসিয়ার ফৌজ বেশুমার। তাদের সংখ্যাধিক্যের প্রতি তাকালে আপনাদের পক্ষে তাদের মোকাবেলা করা অসম্ভব মনে হবে, কিন্তু আপনার ফৌজের মাঝে আত্মোৎসর্গের যে জযবা, আর সামরিক ডিসিপ্লেন আমি দেখেছি, তা রডারিকের বাহিনীতে মোটেও নেই।
এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা পরে করা যাবে। এই মুহূর্তে আমি হলফ করে বলতে পারি, আপনার বাহিনী রডারিকের বাহিনীকে পরাজিত করতে সক্ষম হবে।
আমার মনে প্রতিশোধের যে আগুন জ্বলছে রডারিককে হত্য না করা পর্যন্ত সে আগুন কখনও নির্বাপিত হবে না। আমি তার বাদশাহীকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে চাই।
বন্ধু, আমার মনের এই আকাক্ষা একমাত্র আপনিই পূর্ণ করতে পার। ওয়াদা করছি, এই লড়াইয়ের যাবতীয় সুফল একমাত্র আপনিই ভোগ করবেন। আমাকে শুধু এতটুকু আশ্বাস দিতে হবে যে, সিউটার উপর আপনি কোন রকম হস্তক্ষেপ করবেন না। সিউটাকে একটি স্বাধীন রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেবেন।
***
জুলিয়ানের দুটি মেয়ে। একজনের নাম ফ্লোরিডা, অন্য জনের নাম মেরী। ফ্লোরিডা যতই বড় হচ্ছিল তার সৌন্দর্যের দ্যুতি ততই ছড়িয়ে পড়ছিল। তার মা সখিদের বলতো, “দিনে দিনে মেয়ে আমার যেভাবে রূপের-রানী হয়ে উঠছে, তাতে করে ওর জন্য ওমন রূপের-রাজা কোথায় যে তালাশ করে পাব?
ফ্লোরিডার মার জানা ছিল না যে, তার রূপে-রানী মেয়ে চৌদ্দ বছর বয়সেই তার মনের রাজাকে খুঁজে পেয়েছে। রাজ কুমারীর এই মনের মানুষটি কোন রাজপুত্র ছিল না। সে ছিল তাদেরই শাহী আস্তাবলের শাহসওয়ারের ছেলে।
শাহসওয়ার শাহীখান্দান ও ফৌজী অফিসারদের ছেলে-মেয়েদেরকে ঘোড়সওয়ারী ও তীরন্দাজীর প্রশিক্ষণ দিত। সে সুবাদে শাহীমহলে তার যথেষ্ট মান-সম্মান ও প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল। হেনরি ছিল তার একমাত্র নওজোয়ান ছেলে।
ফ্লোরিডার বয়স যখন তের-চৌদ্দ বছর তখন হেনরির বয়স সতেরো কি আঠারো। বাবার কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে বালক বয়সেই হেনরি শাহসওয়ার হয়ে গিয়েছিল। তীরন্দাজীতেও সে যথেষ্ট দক্ষ ছিল।
ফ্লোরিডার চৌদ্দ বছর বয়স হলে জুলিয়ানের নির্দেশে হেনরির বাবা তাকে সকাল-সন্ধ্যা ঘোড়সওয়ারীর প্রশিক্ষণ দিতে লাগল। একদিন জুলিয়ান হেনরির বাবাকে ডেকে এনে বললেন,
‘আমার মেয়েকে সাধারণ কোন মেয়ে মনে করো না। তুমি জান, আমার কোন ছেলে নেই। এই মেয়েই আমার ছেলের অভাব পূরণ করবে। পুরুষ মনে করে তাকে ঘোড়সওয়ারী ও তীরন্দাজীর প্রশিক্ষণ দেবে, যেন সে দ্রুতগতি সম্পন্ন ঘোড়ার পিঠে চড়ে তলোয়ার চালনা করতে পারে। ঘোড়ার পিঠে চড়েই যেন তীর নিক্ষেপ করতে সক্ষম হয়।’
দেড়-দুই মাসে ফ্লোরিডা ঘোড়সওয়ারীতে এতটাই পারদর্শী হয়ে উঠল যে, ঘোড়ার পিঠে চড়ে সে অনায়াসেই বড়সড় খানাখন্দ ও উর্দু উর্দু ঝোঁপঝাড় টপকে যেতে পারত।
তার উস্তাদ তাকে দূরে কোথাও যেতে দিত না। কিন্তু ফ্লোরিডা ছিল রাজকন্যা। অন্য সকল রাজকন্যার মতো সেও উস্তাদের নির্দেশের প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করে ঘোড়া নিয়ে বহু দূর চলে যেত। ফ্লোরিডার এই ঔদ্ধত্যে তার উস্তাদ চিন্তিত হয়ে পড়ত। তার ভয় হত, মেয়েটি যেমন একরোখা তাতে করে কোন ঝোঁপঝাড় পেরোতে গিয়ে ছোট ঘোড়া থেকে পড়ে যেতে পারে। তাছাড়া তাল সামলাতে না পেরে ঘোড়াই যদি হোছট খেয়ে পড়ে যায়, আর ফ্লোরিডার কোন ক্ষতি হয়, তাহলে তার উপর মহাবিপদ নেমে আসবে।
ফ্লোরিডার উস্তাদ এসব কথা চিন্তা করে অনাগত বিপদ থেকে তাকে উদ্ধারের জন্য একটি প্রতিকার বের করল। ফ্লোরিডা যখন ঘোড়া নিয়ে জঙ্গলের দিকে ছোটে যেতো তখন তার প্রতি লক্ষ্য রাখার জন্য সে তার ছেলে হেনরিকে ঘোড়ায় চড়ে তার অনুসরণ করতে বলে দিল।
একদিন ফ্লোরিডা দেখতে পেল, হেনরি কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে তাকে অনুসরণ করছে। সে যেখানেই যায় হেনরি তার পিছু নেয়। ফ্লোরিডা তখন এনিয়ে কোন আপত্তি তুলেনি। একদিন ফ্লোরিডা গভীর জঙ্গলে এসে ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরল। হেনরি ফ্লোরিডাকে লাগাম টেনে ধরতে দেখে সামান্য দূরে ঘোড়া থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
ফ্লোরিডা পিছন ফিরে হেনরির দিকে তাকিয়ে মুচকি-মুচকি হাসতে লাগল।
হেনরি ছিল পৌরুষদীপ্ত সৌন্দর্যের অধিকারী। তার দেহের গঠনশৈলীই বলে দিতো, সে একজন সুপুরুষ। তাকে দেখলে বুঝা যেত, তার বাহুতে আছে শত্রুকে ধরাশায়ী করার মতো অসীম শক্তি। আর চোখে আছে যে কোন মেয়েকে পাগল করার করার মতো দৃষ্টি।
ফ্লোরিডা ঠোঁটে মিষ্টি হাসির রেখা টেনে বলে উঠল, ‘হেনরি আমাকে ঘোড়া থেকে নামাও। এতটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছি যে, নিচে নামা সম্ভব হচ্ছে না।’