***
‘জুলিয়ান! তুমি আমার জন্য অত্যন্ত সুন্দর একটি ফাঁদ পেতেছ।’ মুসা বললেন। “তোমার বিবেক-বুদ্ধি কি এতটাই লোপ পেয়েছে যে, তুমি এ কথা ভাবার প্রয়োজনই অনুভব করোনি, যাকে তুমি কথার জাদুতে ভুলাতে এসেছ, সে সাধারণ কোন ব্যক্তি নয়। জীবন-যুদ্ধের এক লড়াকু সৈনিক সে। তাঁর তীক্ষ্মদৃষ্টি মানুষের মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা গোপন কথাও বলে দিতে পারে।’
‘এতে কোনই সন্দেহ নেই, আমীর মুসা! জুলিয়ান বললেন। আমি এসব কিছু চিন্তা করে তবেই এসেছি, সেই সাথে আমি আপনার শোকরিয়া আদায় করছি যে, আপনি আমাকে ছোট ভাই মনে করে তুমি বলে সম্ভোধন করেছেন।
জুলিয়ান তার দুটি হাত মুসা বিন নুসাইরের প্রতি প্রসারিত করে বললেন, ‘আমার দোস্তী কবুল করুন এবং আমার মনের মাঝে যে কথা গোপন আছে, সে কথা শ্রবণ করুন।
মুসা বিন নুসাইর জুলিয়ানের হাত দুটি নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে নিলেন। কিছুক্ষণ পর জুলিয়ান নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং দ্রুত হাতে তরবারী কোষ মুক্ত করলেন। তার চেয়েও বেশি দ্রুত মুসার হাত তলোয়ারের বাট স্পর্শ করল। কিন্তু জুলিয়ানের পরবর্তী পদক্ষেপ ছিল আশ্চর্যজনক। তিনি তলোয়ার হাতের তালুতে তুলে দু’কদম অগ্রসর হলেন। অতঃপর হাটু গেড়ে বসে মুসা বিন নুসাইরের পদতলে রেখে দিলেন। তারপর এক পা পিছে সরে এসে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালেন।
‘আমীর মুসা! জুলিয়ান আবেগতাড়িত কণ্ঠে বলে উঠলেন। এই তলোয়ার কখনও কারো সামনে আত্মসমর্পণ করেনি। এই তলোয়ার অনেক শক্তিধর দুশমনের উদ্ধত মস্তক চূর্ণবিচূর্ণ করেছে। মুসা আমার কথায় মনে কষ্ট নিও না। আমাকে দাম্ভিক ও অহংকারী মনে করবেন না। এটা সেই তলোয়ার যাকে স্বয়ং আপনিও পরাস্ত করতে পারেননি। আপনার বার্বার ফৌজ পর্যন্ত এই তলোয়ারের ঝলক দেখে সিউটা থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল।
সেই তলোয়ার আজ আপনার পদতলে রাখা। কোন বাদশাহ বা কোন সিপাহী এতো সহজে নিজের তলোয়ার দুশমনের পদতলে সমর্পণ করে না। কিন্তু আজ আমি আপনাকে আর দুশমন মনে করি না, ভাই মনে করি; দোস্ত মনে করি। আজ এক দোস্ত তার দুঃখের কথা অপর দোস্তকে শোনাতে এসেছে। মুসা! শোনবেন তার দুঃখের কথা? হবেন কি তার দুঃখের ভাগী?
মুসা বিন নুসাইর ঝুঁকে তলোয়ার উঠিয়ে হাতের তালুতে রেখে জুলিয়ানের সামনে পেশ করে বললেন, ‘আমি আনন্দ অনুভব করছি এ জন্য যে, তুমি আমাকে একজন বিশ্বস্ত দোস্ত, আর স্নেহশীল ভাই মনে করছ। আমি তোমার তলোয়ারের কদর করি।
মুসা নিজ হাতে জুলিয়ানের কোমরে ঝুলন্ত কোষে তলোয়ার রেখে দিয়ে বললেন। এখন কি আমার দোস্ত আমাকে তার দুঃখের কথা শোনাবে?’
‘হ্যাঁ, যে কথা শোনাতে এসেছি, তা শোনিয়ে তবেই ফিরে যাব। জুলিয়ান বললেন। আমি আমীর মুসাকে জিজ্ঞেস করছি, কেউ যদি তার মেয়ের ইজ্জত ছিনিয়ে নেয়, তাহলে তিনি তাকে কি শাস্তি দেবেন?
‘অপরাধ প্রমাণিত হলে অপরাধীকে প্রস্তারাঘাতে হত্যা করা হবে। মুসা বিন নুসাইর বললেন।
‘অপরাধী যদি কোন রাজ্যের বাদশাহ হয়?’ জুলিয়ান জানতে চাইলেন।
‘তাহলে মুসা তার বাদশাহী মাটির সাথে মিশিয়ে দেবে। সেই বাদশাহর শাহী হেরেমের মেয়েদেরকে দাসী-বান্দির মতো বন্দী করে সাথে নিয়ে আসবে।
সেই নির্যাতিতা মেয়েটি যদি আপনার কোন দুশমনের হয়।
‘সেই মজলুম মেয়ে এবং তার বাবা যদি ফরিয়াদি হয়ে আসে তাহলে মুসা তারও প্রতিশোধ নিবে। কিন্তু এ ব্যাপারে সে অবশ্যই লক্ষ্য রাখবে যে, প্রতিশোধ নিতে গিয়ে তার সালতানাত যেন কোন হুমকির সম্মুখীন না হয়ে পড়ে।
‘না, মুসা! আপনার সালতানাত কোন হুমকির সম্মুখীন হবে না; বরং আপনার সালতানাত আরো বিস্তৃতি লাভ করবে।’
‘মুসা বিন নুসাইর! সেই মজলুম বাবা স্বয়ং আমি, আর লঞ্ছনার শিকার আমারই মেয়ে।
‘তাহলে তোমার তলোয়ার এখনও কোষবদ্ধ কেন? আমার পদতলেই বা কেন তা সমর্পণ করছ?
‘এ জন্য যে, অপরাধী আমার চেয়েও বেশী শক্তিশালী। সে আন্দালুসিয়ার বাদশাহ। মানুষরূপী শয়তান রডারিক।
‘তোমার মেয়েকে রডারিক পেল কীভাবে?
‘দোস্ত মুসা! এখন আমি রডারিকের করদ-রাজা ঠিক; কিন্তু আমার সম্পর্ক আন্দালুসিয়ার শাহীখান্দানের সাথে। এক সময় আমার রাজ্য আজাদ ছিল। সময়ের পালাবদলে সিউটার প্রতিরক্ষার দায়ভার আন্দালুসিয়ার বাদশাহ নিজ হাতে তুলে নেয়। এভাবেই সিউটা আন্দালুসিয়ার করদরাজ্যে পরিণত হয়। আমি রাজা থেকে গভর্নর হয়ে যাই।
আমাদের শাহীখান্দানের নিয়ম হল, কোন মেয়ে পনের-ষোল বছরে উপনীত হলে, তাকে আন্দালুসিয়ার শাহীমহলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে সে শাহী আদব-কায়দা, কথাবার্তা ও চাল-চলন সম্পর্কে অবগত হতে পারে। শাহীখান্দানের লোকেরা কখনও কখনও তাদের দশ-বারো বছরের মেয়েকেও শাহীমহলে পাঠিয়ে দেয়।
আমিও আমার মেয়ে ফ্লোরিডাকে শাহীখান্দানের নিয়ম অনুযায়ী রডারিকের শাহীমহলে পঠিয়ে দিয়েছিলাম। তখন তার বয়স সতেরো বছরের চেয়ে কিছু কম ছিল। যেহেতু আসল উদ্দেশ্য ছিল শাহী আখলাক এবং শিষ্টাচার শিক্ষা দেওয়া, সেহেতু বিভিন্ন খান্দান থেকে আগত উঠতি বয়সের মেয়েদেরকে শাহীখান্দানের মহিলাদের তত্ত্বাবধানেই রাখা হত। পুরুষদের সাথে তাদের কোন রকম সম্পর্ক থাকতো না। কিন্তু আমার মেয়ে আমাকে জানিয়েছে, রডারিক প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে তার ইজ্জত লুণ্ঠন করেছে।