সহকারী সালার খলীফাকে এজেলুনা সম্পর্কে সবকিছু বললেন। ছোট দরজার কথাও বললেন। অবশেষে জানালেন, একজন প্রশাসকও আমীরের প্রতি সন্তুষ্ট নন। আমীরের প্রতি শুধু অসন্তুষ্ট থাকলে কোন চিন্তা ছিল না। চিন্তার বিষয় হল, সিপাহী, শহরের অধিবাসী ও প্রশাসকগণ যে কোন সময় বিদ্রোহ করে বসতে পারে। সকলের মনেই আমীরের প্রতি প্রচণ্ড ক্ষোভ বিরাজ করছে।
খলীফা আর কিছু শুনতে চাচ্ছিলেন না। তিনি রাগে-গোসায় অগ্নিশর্মা হয়ে পড়েছিলেন। মুসা বিন নুসাইরের খান্দানের সদস্যদের বিরুদ্ধে সামান্য বাহানাই তার জন্য যথেষ্ট ছিল। মুসা বিন নুসাইরের বিরুদ্ধে এই অভিযোগও ছিল যে, তিনি খলীফার অনুমতি ছাড়াই তার ছেলেকে আন্দালুসিয়ার আমীর নিযুক্ত করেছিলেন। সুলায়মান তার পছন্দের কাউকে এই পদ দিতে চাচ্ছিলেন।
‘তুমি আন্দালুসিয়া ফিরে যাও।’ সুলায়মান বললেন। “সকলকে বলো, আমি অতিসত্ত্বর তাদের এই সমস্যার সমাধান করব।
***
আন্দালুসিয়ার আমীর আবদুল আযীযের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ ছিল, তা এভাবে নিরসন হল যে, একদিন তিনি ফজরের নামায পড়াচ্ছিলেন। প্রথম রাকাতে সূরা ফাতেহা শেষ করে যেই সূরা ওয়াকিয়া তেলাওয়াত শুরু করেন, ওমনি প্রথম কাতার থেকে এক ব্যক্তি বিদ্যুৎবেগে সামনে অগ্রসর হয়ে চোখের পলকে তরবারী বের করে এক আঘাতে তার মাথা দেহ থেকে পৃথক করে ফেলে। নামাযরত লোকজন কোন কিছু বুঝার আগেই আঘাতকারী কর্তিত মস্তক উঠিয়ে নিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়।
এই ঘটনার বিশ-পঁচিশ দিন পর আবদুল আযীযের কর্তিত মস্তক একটি চামড়ার থলিতে ভরে মখমলের কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে দামেস্কে খলীফা সুলায়মানের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। কর্তিত মস্তক দেখে খলীফা কারারক্ষীকে নির্দেশ দেন, ‘আন্দালুসিয়ার আমীরের কর্তিত মস্তক কয়েদখানায় তার বাবার সামনে রেখে এসো।’
নির্দেশ পালন করা হয়। আবদুল আযীযের কর্তিত মস্তক কয়েদখানায় তার পিতা মুসা বিন নুসাইরের সামনে রেখে আসা হয়। মুসা বিন নুসাইর পূর্ব থেকেই অকথ্য জুলুম-নির্যাতন, আর লাঞ্ছনা-গঞ্জনার কারণে অন্তিম অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিলেন। এক্ষণে প্রাণপ্রিয় পুত্রের কর্তিত মস্তক দেখে হুঁশ হারিয়ে ফেলেন। হুঁশ ফিরে এলে দেখেন মস্তক সেখানে নেই।
মুসা বিন নুসাইর প্রিয় পুত্রের কর্তিত মস্তক দেখে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘তারা এমন এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছে, যে দিনের আলোতে ন্যায় ও ইনসাফের সাথে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করত, আর রাতের আঁধারে আল্লাহ তাআলার ইবাদত করত। ছেলে আমার রাতের অন্ধকারে ইবাদতে লিপ্ত থাকত, আর দিনের বেলা রোযা রাখত।
ইতিহাসও এ কথার সাক্ষী দেয় যে, আবদুল আযীয দিনের আলোতে ন্যায় ও ইনসাফের সাথে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতেন, আর রাতের অন্ধকারে আল্লাহ তাআলার ইবাদতে মশগুল থাকতেন। কিন্তু তিনি এ কথা বুঝতে সক্ষম ছিলেন না যে, কোন পুরুষ যখন কোন নারীকে তার ইচ্ছাশক্তির উপর প্রাধান্য দেয় তখন সে নারী পুরুষের বিবেক-বুদ্ধির উপর বেঁকে বসে এবং সেই পুরুষকে কাঠের পুতুল বানিয়ে ছাড়ে। সম্ভবত তিনি এটাও জানতেন না যে, ছলনাময়ী নারীর কারণে অনেক রাজা-বাদশাহও পথের ভিখারী হয়ে গেছেন। রাজসিংহাসন তাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। জেনে হোক বা না জেনে হোক, আবদুল আযীযও এই ভুলের শিকারে পরিণত হয়েছিলেন। তিনি এক নারীকে তার ইচ্ছাশক্তির উপর প্রাধান্য দিয়েছিলেন।
মুসা বিন নুসাইর অবশ্যই একজন বিদগ্ধ ও বিচক্ষণ ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু তিনিও মানব স্বভাবের অন্য আরেকটি দুর্বলতার শিকার হয়ে পড়েছিলেন। মানব স্বভাবের সেই দুর্বলতা হল, মানুষ যখন কারও গুণে মুগ্ধ হয়ে তার সামনে অবনত হয়ে পড়ে তখন সে নিজেকে খোদা ভাবতে শুরু করে দেয়। তোষামোদ তখন তার কাছে পছন্দনীয় হয়ে উঠে। আত্মপ্রশংসা ও আত্মতৃপ্তির দুর্বলতা তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে।
মুসা বিন নুসাইর পুত্রের কর্তিত মস্তক দেখার পর অল্প কয়েক দিনই জীবিত ছিলেন। ৭১৬ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর এক বছর পর খলীফা সুলায়মানও মারা যান।
জুলিয়ান ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নেন। তিনি সিউটার রাজা হিসেবে বহাল থাকেন। খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দিতে আৰু সুলায়মান আইউব নামে ইসলামী ফেকাহ ও শরীয়তের একজন বহুত বড় আলেম অতিবাহিত হয়েছেন। তিনি জুলিয়ানের তৃতীয় অধস্তন পুরুষের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
একজন ইহুদি জাদুকর বলেছিল, আন্দালুসিয়ার মাটি হল, রক্ত পিপাসু। সে সবসময় রক্ত পান করতে চায়। জাদুকরের এই কথা কঠিন বাস্তব হয়ে দেখা দেয়। মুসা বিন নুসাইর এবং তার পুত্রকে হত্যা করা হয়। মুগীস আর-রুমীকেও হত্যা করা হয়। এরপর আন্দালুসিয়ায় মুসলমানদের আটশ বছরের ইতিহাসে যুদ্ধ-বিগ্রহের ঘটনা ঘটতেই থাকে। হত্যা ও প্রতিহত্যার মাধ্যমে সিংহাসন হাতবদল হতে থাকে। পরিণামে একদিন আন্দালুসিয়া ইসলামী সালতানাত থেকে পৃথক হয়ে যায়।