এজেলুনা যে নিয়ম চালু করেছিল তাতে করে সালারগণ ও উচচপদস্থ কর্মকর্তাগণ দিন দিন অসন্তুষ্ট হয়ে পড়ছিলেন। এ ব্যাপারে আবদুল আযীযের কাছে তারা অভিযোগ নিয়ে গেলে তিনি হেসে উড়িয়ে দিতেন। একদিকে ছিল আবদুল আযীযের সুমহান কীর্তি। তিনি ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করার সাথে সাথে মানুষের অন্তরে ইসলামের প্রতি আনুগত্য সৃষ্টি করেছিলেন। দিন-রাত মেহনত করে দেশ ও জনগণের জন্য ঈর্ষনীয় পর্যায়ের উন্নতি সাধন করেন। জনহিতকর আইন-কানুন প্রণয়ন করেন। ফলে সাধারণ মানুষ আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হওয়ার সাথে সাথে ইজ্জত ও সম্মানের জীবন লাভ করে। অপরদিকে আবদুল আযীয এক নারীকে নিজের উপর অত্যধিক প্রাধান্য দিয়ে অকৃত্রিম বন্ধুদের কাছে বিরাগভাজন হয়ে পড়েন।
এজেলুনা আবদুল আযীযের জন্য নিয়মিত দরবারের আয়োজন করত। সে আবদুল আযীযের পিছনে দাঁড়ানোর জন্য দু’জন বিশেষ প্রহরী নিযুক্ত করেছিল। তারা রাজা-বাদশাহদের প্রহরীর ন্যায় জাঁকজমকপূর্ণ লেবাস পরিধান করত। এ প্রথাও ইসলাম সমর্থিত ছিল না।
ঐতিহাসিকগণ লেখেন, এজেলুনা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের উপরও তার কর্তৃত্ব চালাত। একদিন উচচপদস্থ কর্মকর্তাগণ সকলে মিলে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, এ ব্যাপারে খলীফাকে সব কিছু জানানো হবে। কোন কোন কর্মকর্তার সিদ্ধান্ত এমন ছিল যে, শেষ বারের মতো আবদুল আযীযকে সতর্ক করা হোক, তিনি যেন এই নারীর মোহজাল থেকে বের হয়ে আসেন, অন্যথায় এর পরিণতি হবে এই রাজ্যের জন্য এবং ইসলামের জন্য অত্যন্ত ভয়াবহ। অবশেষে শেষোক্ত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ করার জন্য সকলেই ঐকমত্য পোষণ করেন।
***
আবদুল আযীয সারাক্ষণই ব্যস্ত থাকতেন। তিনি রাজ্যের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদেরকে সময় দিতে পারতেন না। আসল কারণ হল, এজেলুনা আবদুল আযীযকে তাদের সাথে বসার সুযোগ দিত না। এ সময় এজেলুনা আবদুল আযীযকে এই পরামর্শ দেয় যে, আপনি এই রাজ্যের বিধানদাতা। আমি লক্ষ্য করছি, মুসলিম প্রশাসকগণ আপনার সমকক্ষতা দাবি করছেন, আপনি তাদেরকে বলুন, তারা যখন আপনার সাথে সাক্ষাত করতে দরবারে আসবে তখন তারা যেন ঝুঁকে আপনাকে সালাম করে। এতেকরে তাদের উপর আপনার প্রভাব বজায় থাকবে। অন্যথায় দেখবেন, একদিন তারা আপনার হুকুম মানতে অস্বীকার করে বসবে।’
‘না, এজেলুনা! আমি এমন হুকুম দিতে পারি না। আবদুল আযীয বললেন। আমি এতটা নীচে নামতে পারব না। আমার আল্লাহ ও রাসূলের নির্দেশ হল, কোন মানুষ কোন মানুষের সামনে মাথা ঝুকাবে না। একমাত্র আল্লাহর সামনে মাথা ঝুঁকাবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনেও কেউ মাথা ঝুকাত না। কারও সামনে মাথা ঝুঁকানো আর কাউকে মাথা ঝুঁকাতে হুকুম করা সমান অপরাধ।
এজেলুনা আবদুল আযীযকে তার সমতে আনতে অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হল। এজেলুনা খুবই শক্ত ধাতুর তৈরী মেয়ে মানুষ ছিল। সে তার কথা না মানিয়ে ক্ষান্ত হওয়ার পাত্রী ছিল না। সে আবদুল আযীযের সাথে সাক্ষাত প্রার্থীদের জন্য একটি পৃথক কামরা তৈরী করালো। সে কামরায় প্রবেশের জন্য এমন দরজা লাগানো হল যে, প্রবেশকারীকে প্রায় রুকুর মতো মাথা ঝুঁকিয়ে সেখানে প্রবেশ করতে হত। দরজার সামনে রাখা কুরসিতে আবদুল আযীয বসে থাকতেন। এভাবে এজেলুনা তার মনের ইচ্ছা পূর্ণ করল।
সালারগণ ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণ দরজা দেখেই বুঝতে পারলেন যে, কী উদ্দেশ্যে এই দরজা বানানো হয়েছে। একজন শাহী কর্মচারীও তাদেরকে বলে দিল যে, আমীরের সামনে মাথা ঝুঁকানোর জন্যই এজেলুনা এই দরজা লাগিয়েছে। এটা তাদের প্রতি এমন এক আঘাত ছিল যে, কেউই তা সহ্য করতে পারলেন না। সকলেই বলতে লাগলেন, আমাদেরকে অপমান করার জন্য নয়; বরং ইসলামকে অপমান করার জন্যই এজেলুনা এ ব্যবস্থা করেছে।
এ সময়টিতে আবদুল আযীয আন্দালুসিয়া থেকে বিপুল পরিমাণ খাজনা উসুল করে দারুল খেলাফত দামেস্ক পাঠানোর ব্যবস্থা করছিলেন। এটাই ছিল আন্দালুসিয়া থেকে পাঠানো প্রথম খাজনা। একজন সহকারী সালার এই খাজনা নিয়ে যাচ্ছিলেন। ইতিহাসে এই সহকারী সালারের নাম লেখা হয়নি।
***
সহকারী সালার দামেস্ক পৌঁছে খলীফা সুলায়মানের সাথে সাক্ষাত করেন এবং আন্দালুসিয়া থেকে নিয়ে আসা খাজনা ও হাদিয়া-তোহফা পেশ করেন।
‘আন্দালুসিয়ার খবর কী? খলীফা সুলায়মান জানতে চান। কেমন চলছে আন্দালুসিয়ার হুকুমত?
‘হুকুমত তো ঠিকই চলছে, আমীরুল মুমিনীন!’ সহকারী সালার বললেন। ‘কিন্তু হুকুমত পরিচালনাকারী ঠিক মতো চলছেন না।’
‘খোলাসা করে কথা বলো।’ সুলায়মান গম্ভীর কণ্ঠে বললেন। মনে হচ্ছে, সেখানে এমন কিছু হচ্ছে, যা হওয়া উচিত নয়।’
‘আমীরুল মুমিনীন! সহকারী সালার বললেন। আপনার প্রশ্নের জবাব আন্দালুসিয়ার সকল সালার ও কর্মকর্তাগণ দিয়েছেন। তাঁরা আমাকে এই দায়িত্ব দিয়েছেন, আমি যেন সেখানকার প্রকৃত অবস্থা আপনার সামনে তুলে ধরি। মূলত আন্দালুসিয়ায় এখন এক অমুসলিম নারীর হুকুমত চলছে।’
‘এ তো সেই খ্রিস্টান নারী নয়, যাকে আবদুল আযীয শাদী করেছে?’ সুলায়মান জিজ্ঞেস করলেন। সে নারী সম্ভবত এখনও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেনি!
‘হ্যাঁ, আমীরুল মুমিনীন! তার কথাই বলছি।’ সহকারী সালার বললেন। ‘তার নাম এজেলুনা। আমীর আবদুল আযীয তাকে রানী বানিয়ে রেখেছেন। সে বড় বড় প্রশাসকগণকেও আন্দালুসিয়ার আমীরের সাথে সাক্ষাত করতে দেয় না। সেখানে বাদশাহী দরবার বসে, আর হুকুম চলে এজেলুনার।