কোন ইতিহাসবিদই লেখেননি যে, তারিক বিন যিয়াদ বাকী জীবন দামেস্কেই অতিবাহিত করেছেন নাকি স্বীয় জন্মভূমি উত্তর আফ্রিকা চলে গিয়েছিলেন? ইতিহাসে শুধু এতটুকু পাওয়া যায় যে, সুলায়মান তাঁকে কোন যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে নিষেধ করেছিলেন। এভাবেই আন্দালুসিয়ার মহান বিজেতা গুমনামীর অন্ধকারে হারিয়ে যান। অথচ তিনি এই চিন্তা করে আন্দালুসিয়ার সমুদ্রসৈকতে যুদ্ধজাহাজগুলো জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন, যেন ফিরে যাওয়ার কোন উপায় অবশিষ্ট না থাকে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বপ্নযোগে যে মহান যোদ্ধাকে বিজয়ের সুসংবাদ দিয়েছিলেন, তিনি ইতিহাসের অন্ধকার গহ্বরে হারিয়ে যাবেন–এটা কিছুতেই হতে পারে না। ইতিহাসের পাতায় তারিক বিন যিয়াদ এমনই এক মহাপুরুষ হয়ে বেঁচে আছেন, যিনি শত-সহস্র বছর পরও মুসলিম জনপদে ও প্রজন্ম পরম্পরায় যুবসমাজের হৃদয়ে বীরত্ব ও সাহসিকতার উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে বিরাজ করছেন। কোন অমুসলিমও যখন আন্দালুসিয়ার ইতিহাস চর্চা করেন তখন তিনিও তারিক বিন যিয়াদকে শুধুমাত্র একজন বীরই মনে করেন না; বরং তার প্রতি স্বশ্রদ্ধ সালাম পেশ করেন।
***
মুসা বিন নুসাইর কারাগারের অন্ধকারে ধীরে ধীরে মুত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। ওদিকে তার ছেলে আবদুল আযীয আন্দালুসিয়ার জনসাধারণের জীবনধারা পাল্টে দিচ্ছিলেন। আবদুল আযীয ছিলেন দুনিয়াবিমুখ ও পুণ্যবান ব্যক্তি। ইসলাম ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামে উৎসর্গিত প্রাণ। তার বিজ্ঞতাপূর্ণ শাসন ব্যবস্থা এবং ইসলামী নিয়ম-নীতির প্রতি পূর্ণ আনুগত্য মুসলমান ও খ্রিস্টানদের মাঝে ভ্রাতৃত্বের সেতুবন্ধন তৈরী করে বাহ্যত তাদেরকে এক জাতিতে পরিণত করেছিল।
আন্দালুসিয়ায় বেগার খাটানো ও দাসত্ব প্রথা চালু ছিল। সেখানকার খ্রিস্টান ও ইহুদি আমীর-উমারা, নেতৃবর্গ ও জায়গিরদাররা গরীব কৃষক-শ্রমিককে নামমাত্র খাদ্যের বিনিময়ে ব্যবহার করত। এসকল দরিদ্র লোকদের কৃষি জমি ক্রয় করা ও গৃহ নির্মাণের কোন অধিকার ছিল না। আবদুল আযীয এই অমানবিক প্রথা বন্ধ করার জন্য হুকুম জারি করেন। তিনি কৃষক-শ্রমিকদেরকে জমি ক্রয়ের ও গৃহ নির্মাণের অধিকার প্রদান করেন। জনসাধারণের মাঝে এই হুকুমের প্রভাব এতটা ব্যাপক আকারে পরিলক্ষিত হয় যে, দলে দলে লোকজন মুসলমান হতে শুরু করে। ইহুদি ও খ্রিস্টানদের উপাসনালয়গুলো বিরান হতে থাকে। দিন দিন মসজিদসমূহে নামাযীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। আন্দালুসিয়ার বিভিন্ন শহরে আজও সেই সময়ের নির্মিত অসংখ্য দৃষ্টিনন্দন মসজিদ অবশিষ্ট আছে।
আবদুল আযীয আন্দালুসিয়ার নির্যাতিত-নিষ্পেষিত জনগণকে সম্মান ও মর্যাদার জীবন প্রদান করেন। তিনি খ্রিস্টানদের ধর্মীয় বিষয়ে কোনরূপ হস্তক্ষেপ করেননি। তবে পাদ্রিরা ধর্মের নামে যে অপকর্ম ও অধর্ম চালু করেছিল, তিনি সেগুলোর শিকড় উপড়ে ফেলেন। পাদ্রিরা জনসাধারণের উপর যে শাসন-শোষণ ও জুলুম-নির্যাতন চালাত চিরতরে তার পথ বন্ধ করে দেন।
আবদুল আযীয এমন সময় আন্দালুসিয়ার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন যখন গোটা রাজ্যে বিশৃঙ্খলা-অরাজকতা ও বিশ্বাসহীনতার পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। লোকজন ঘর-বাড়ি ছেড়ে আশ-পাশের রাজ্যে পালিয়ে যাচ্ছিল। আবদুল আযীয গোটা রাজ্যে এমন এক শান্তির পরিবেশ তৈরী করেন যে, পালিয়ে যাওয়া লোকজন পুনরায় যার যার গৃহে ফিরে আসে। যেসকল জায়গিরদার ও নবাবরা মুকুটহীন বাদশাহ সেজে বসেছিল তিনি তাদের সেই বাদশাহী খতম করে দিয়ে ছিলেন এবং জনগণের প্রতি তাদের হারিয়ে যাওয়া সম্মান ও মর্যাদা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। ব্যবসা-বাণিজ্যের এমন প্রসার ঘটিয়ে ছিলেন যে, ইতিপূর্বে যেসকল লোক দারিদ্র সীমার নীচে বসবাস করত, তারাও এখন সুখ-স্বাচ্ছন্দময় জীবনযাপন করছিল।
আবদুল আযীয প্রকৃত জ্ঞানী ও গুণী লোক ছিলেন। তিনি শুধুমাত্র কথার মাধ্যমে ইসলামের প্রচার-প্রসার করেননি; বরং বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করার মাধ্যমে জনসাধারণের মাঝে ইসলামের গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি করেছিলেন। অন্য ধর্মের লোকজন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে গর্ব অনুভব করত। ফজরের নামায ও জুমার নামাযের ইমামতি তিনি নিজেই করতেন। এতকিছুর পরও তাঁর খ্রিস্টান স্ত্রী ছিল তাঁর জন্য কমজোরীর বড় কারণ। আবদুল আযীযের মতো অকুতোভয় সিপাহসালার, সুভিজ্ঞ আলেমে দ্বীন এবং বিচক্ষণ শাসক যখন এজেলুনার কাছে আসতেন তখন তিনি একজন দুর্বলচিত্রের মানুষে পরিণত হয়ে যেতেন। খ্রিস্টান হওয়ার কারণে এজেলুনা বেপর্দা ঘুরাফেরা করত। সে তার অধীনস্থদের উপর হুকুম চালাত। তার মনের পুরনো ইচ্ছা ছিল, সে রাজরানী হবে। প্রকৃত অর্থে সে রানী হয়ে গিয়েছিল। তার চাল-চলন আর আচার-আচরণ ছিল রানীর মতো।
আবদুল আযীযের দুর্বলতার মূল কারণ হল তার হৃদয়ে এজেলুনার প্রতি সীমাহীন মহব্বত ছিল। এজেলুনা তার কথার জাদু আর আকর্ষণীয় অঙ্গ-ভঙ্গি দিয়ে আবদুল আযীযের উপর প্রাধান্য বিস্তার করে রেখেছিল। আবদুল আযীয ছিলেন সহজ-সরল মানুষ। তিনি বাদশাহ হতে চাইতেন না। কিন্তু এজেলুনা এমন রীতি-নীতি চালু করেছিল যে, আবদুল আযীযকে সকলেই বাদশাহর মতোই সম্মান প্রদর্শন করত। কেউ আবদুল আযীযের সাথে সাক্ষাত করার জন্য আসলে এজেলুনা খাদেমের মাধ্যমে বলে পাঠাত, আমীরের সাথে এখন সাক্ষাত করা যাবে না। ওমুক সময় এসো। যদি কোন সালার বা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা দেখা করতে চাইত তাহলে এজেলুনা নিজেই তাদের সাথে দেখা করে কথাবার্তা বলত। তারা কখনও সামরিক ও প্রশাসনিক কোন বিষয়ে আমীরের ফয়সালা জানতে চাইলে অধিকাংশ সময় এজেলুনা নিজেই সিদ্ধান্ত দিয়ে দিত। মুসলিম সমাজে এ জাতীয় কাজকর্মকে অত্যন্ত নিন্দনীয় মনে করা হয়। আমীরের উপস্থিতিতে তাঁর স্ত্রী প্রশাসনিক কাজে হস্তক্ষেপ করবে, ফয়সালা প্রদান করবে–এটা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। ইসলামের বিধান হল, কোন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, সিপাহসালার, এমনকি আমীরুল মুমিনীনের সাথে যে কোন ব্যক্তি যে কোন সময় বিশেষ প্রয়োজনে সাক্ষাত করতে পারবে। প্রয়োজনে অর্ধ রাত্রিতেও তাঁদেরকে ঘুম থেকে জাগানো যাবে।