‘আমি যদি না আসতাম তাহলে ওলিদ অসন্তুষ্ট হতেন।’ মুসা বিন নুসাইর বললেন। তার নির্দেশ খুবই কঠিন ছিল।’
‘তুমি না আসলেই ভাল হত, ইবনে নুসাইর! তুমি না আসলেই ভাল হত। ইবনুল মুহাল্লাব বললেন। “তুমি একটি বিশাল রাজ্য জয় করেছিলে। তারিক বিন যিয়াদ ও মুগীস আর-রুমীর মতো অন্যান্য সালাররাও তোমাকে শুধু আমীর নয়; জন্মদাতা পিতার মতো শ্রদ্ধা করত। তাছাড়া তোমার কাছে অসীম সাহসী যুদ্ধজয়ী বিশাল এক বাহিনী ছিল। রাষ্ট্রীয় কোষাগারে সম্পদের কোন কমতি ছিল না। বার্বার সম্প্রদায় তোমার অনুগত ছিল। রাজ্য এতটাই উর্বর যে সেখানে খাদ্যের কোন অভাব নেই। তারপরও তুমি দামেস্কের জাহান্নামে কেন এলে? নিজেকে আন্দালুসিয়ার স্বাধীন বাদশাহ ঘোষণা করে দিতে! সমুদ্রের ওপারে কোন খলীফাই দামেস্ক থেকে তোমার বিরুদ্ধে সৈন্য পাঠাত না।’
‘ইবনুল মুহাল্লাব, আমি গুনাহগার ঠিকই, কিন্তু আমি আমীরুল মুমিনীনের হুকুম অমান্য করতে চাচ্ছিলাম না। মুসা বিন নুসাইর বললেন। আমি তারিক বিন যিয়াদকে বেত্রাঘাত করেছিলাম। কারণ, সে আমার হুকুম অমান্য করেছিল। যদি আমাদের বিজিত রাজ্যের আমীরগণ নিজেদেরকে স্বাধীন বাদশাহ ঘোষণা করে তাহলে ইসলামী সাম্রাজ্য খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যাবে, উম্মতে মুহাম্মদীর ঐক্যের বাঁধন ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে, ইসলাম মক্কা মুকাররমার মাঝে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে।
‘ইবনে নুসাইর, ধন্যবাদ তোমাকে। ইবনুল মুহাল্লাব বললেন। আমি যা বললাম, তোমার তাই করা উচিত ছিল–আমি তা বলছি না। আমি তোমার মনের কথা জানতে চাচ্ছিলাম। কথা দিচ্ছি, খলীফা সুলায়মানের সাথে তোমার সমঝোতার ব্যাপারে আমি আপ্রাণ চেষ্টা করব।’
ইবনুল মুহাল্লাবের কথার উত্তরে মুসা বিন নুসাইর যে কথা বলেছিলেন, তা আজও ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে।
‘ইবনুল মুহাল্লাব, পানির প্রাণীর দৃষ্টিশক্তি এতটাই তীক্ষ্ণ যে, তারা নদী-সমুদ্রের তলদেশের ধূলিকণা পর্যন্ত দেখতে পারে, কিন্তু তাদেরকে ধরার জন্য যে জাল নিক্ষেপ করা হয় তা দেখতে পায় না। আমি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলাম ঠিকই; কিন্তু সুলায়মানের জালে আটকা পড়ে গেছি।’
ঐতিহাসিকগণ লেখেছেন, ইবনুল মুহাল্লাব মুসা বিন নুসাইরের বীরত্ব ও অসংখ্য বিজয়-কৃতিত্বের কথা উল্লেখ করে সুলায়মানের কাছে থেকে তাঁর মুক্তির ব্যাপারে আদেশনামা জারি করতে অনেক চেষ্টা করেন, কিন্তু সুলায়মান এতটাই কঠিন হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন যে, শেষ নিঃস্বাস ত্যাগ করার আগ পর্যন্ত তিনি মুসা বিন নুসাইরকে ক্ষমা করেননি।
এ সময় আচানক আততায়ীর হাতে মুগীস আর-রুমী নিহত হয়ে যান। কে বা কারা তাঁকে হত্যা করেছে, তার কোন হদিস পাওয়া গেল না। ধারণা করা হয় যে, আমীর মুসার কোন ভক্ত বা আত্মীয় তাঁকে হত্যা করেছে। কারণ, মুসা বিন নুসাইরের এই অবস্থার জন্য তিনি অনেকটা দায়ী ছিলেন। কিন্তু প্রকৃত সত্য হল, সুলায়মানই ছিলেন মুগীসের হত্যাকারী।
সুলায়মান খেলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর পরই ইসলামী সালতানাতের সকল গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গকে হত্যা করে ফেলেন। সুলায়মান হিন্দুস্তানে ইসলামের ঝাণ্ডা স্থাপনকারী সিন্দু বিজেতা মুহাম্মদ বিন কাসেমকে দামেস্কের কারাগারে বন্দী করে অসহনীয় কষ্ট দিয়ে হত্যা করেন। সমরকন্দ বিজেতা কুতায়বা বিন মুসলিমকে একই কারাগারে হত্যা করেন। ইরাকের গভর্নর ইয়াযিদ বিন আবি মুসলিমকে–যিনি হাজ্জাজ বিন ইউসুফের আস্থাভাজন ব্যক্তি ছিলেন সুলায়মানের নির্দেশে দামেস্কের কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়। ভাগ্যের জোরে তিনি প্রাণে বেঁচে যান। পাঁচ বছর তিনি বন্দী ছিলেন। সুলায়মানের মৃত্যু হলে তিনি মুক্ত হয়ে আফ্রিকার আমীর নিযুক্ত হন।
ইবনুল মুহাল্লাব ছিলেন সুলায়মানের প্রকৃত দোস্ত। ইবনুল মুহাল্লাব সবসময় আনন্দ-ফুর্তিতে মেতে থাকতেন। দু-হাতে পয়সা উড়াতেন। একবার তিনি বায়তুল মালের ষাট লক্ষ দেরহাম আত্মসাৎ করলে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ তাঁকে আত্মসাৎকৃত অর্থ ফেরত দেওয়ার হুকুম দেন, কিন্তু তিনি ব্যর্থ হন। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ তাঁকে গ্রেফতার করে কয়েদখানায় নিক্ষেপ করেন। তিনি কয়েদখানা থেকে পালিয়ে যান। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ও খলীফা ওলিদের মৃত্যু হলে তিনি ফিরে আসেন। সুলায়মানের সাথে তার গভীর বন্ধুত্ব ছিল। সুলায়মান তাকে পূর্ব পদে পুনর্বহাল করে বলেন, ‘ইবনুল মুহাল্লাবের সন্তানাদির দিকে কেউ চোখ তুলে তাকালে আমি তার চোখ উপড়ে ফেলব।
সুলায়মানের এই ঘোষণা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। এ থেকে বুঝা যায়, সুলায়মান যেমন বদদ্বীন ও অসঙ্কর্মপরায়ন ছিলেন, তেমনি বদদ্বীন ও অসৎকর্মপরায়ন লোকদেরকেই বড় বড় পদে নিযুক্ত করে রেখেছিলেন।
তারিক বিন যিয়াদ বলতে গেলে অনেকটা ভাগ্যবান ছিলেন। কারণ, তিনি সুলায়মানের হাতে নিহিত হননি। তারিক ছিলেন বাবার সম্প্রদায়ের। সুলায়মানের সাথে তাঁর খান্দানি কোন দুশমনি ছিল না। নেতৃত্ব বা রাজনীতি নিয়ে কোন দ্বন্দ্ব-কলহও ছিল না। খলীফা ওলিদ মুসা বিন নুসাইর ও তারিক বিন যিয়াদকে অনেক উপহার-উপঢৌকন দিয়ে সম্মানিত করেছিলেন। তিনি উভয়কে একটি করে বাড়ি প্রদান করেছিলেন। সুলায়মান মুসা বিন নুসাইরকে উপহারের অর্থ ও বাড়ি থেকে বঞ্চিত করেন, আর তারিক বিন যিয়াদকে আরও বেশি হাদিয়া-তোহফা প্রদান করে এই নির্দেশ দেন, তিনি যেন বাকী জীবন নিজ গৃহে অতিবাহিত করেন।