‘তাঁর এই অপরাধও কি ছোট করে দেখার সুযোগ আছে যে, তিনি তাঁর ছেলেকে আন্দালুসিয়ার আমীর নিযুক্ত করেছেন। মুগীস বললেন। তিনি আফ্রিকাকে তিন ভাগে বিভক্ত করে সেখানকার শাসনভার তাঁর অপর তিন ছেলের হাতে তুলে দিয়েছেন। আন্দালুসিয়া, আর আফ্রিকায় কোন বার্বার সালারের কি কোনই অধিকার নেই। আন্দালুসিয়ার বাদশাহ আর তার ভয়ঙ্কর সমর শক্তিকে বার্বার সিপাহীরাই পরাস্ত করেছিল। তারাই আমীর মুসার বিজয়ের পথ সুগম করে দিয়েছিল।
‘আর কিছু শুনার মত ক্ষমতা আমার নেই।’ খলীফা ওলিদ বললেন। ‘একদিকে তোমাদের সেই বিজয়গাথা, যা ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। অনাগত প্রজন্ম তোমাদেরকে নিয়ে গর্ববোধ করবে। তোমাদের সমাধিতে ফুলের সওগাত পেশ করবে। অপরদিকে তোমাদের এই নীচু মানসিকতা আর নিষ্ঠার দৈন্যতা তোমাদেরকে ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে। তোমরা একজন আরেকজনকে হেয় করার চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছ। আমার ভাবতেও অবাক লাগছে, মুসা বিন নুসাইরের মত প্রবীণ, বিদগ্ধ আর বুদ্ধিমান আমীর যদি এতটা নীচু মানসিকতা পোষণ করেন তাহলে উম্মতে মুহাম্মদীর ভবিষ্যত কি হবে?
খলীফা ওলিদ উঁচু মানসিকতা সম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। তিনি আল্লাহকে ভয় করতেন এবং সকল কাজ আল্লাহর রেজামন্দি অনুযায়ী করতে চেষ্টা করতেন। জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে তিনি অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। হেকিম তাঁকে বিছানা থেকে উঠতে নিষেধ করেছিলেন। শরীরের এই নাযুক অবস্থা আর হেকিমের নিষেধাজ্ঞাসত্ত্বেও আন্দালুসিয়ার বিজেতাদের আগমনের সংবাদ শুনে তিনি শুধু বিছানা ছেড়েই উঠেননি; বরং জুমা নামায পড়ানোর ইচ্ছা পোষণ করেন। তিনি হাসি মুখেই জুমার নামায আদায় করেন। কিন্তু মুসা বিন নুসাইরের প্রশ্নবিদ্ধ আচরণ, আর তারিক বিন যিয়াদ ও মুগীস আর-রুমীর তীক্ত কথার কারণে এতটাই ব্যথিত হন যে, কথা বলতে বলতে তিনি একেবারে মুষড়ে পড়েন। অবশেষে তিনি শুধু এতটুকুই বলতে পারেন :
এদের সকলকে পঞ্চাশ হাজার করে দেরহাম পুরস্কার হিসেবে প্রদান করা হোক। আমি কাউকেই খালি হাতে ফিরিয়ে দেব না। এখন সকলকে যেতে বললো।
মুহূর্তের মধ্যে খলীফার রোগের প্রকোপ বেড়ে গেল। সাথে সাথে তাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে হেকিম ডেকে পাঠানো হল। হেকিম এসে নাড়ি পরীক্ষা করে বললেন, তোমরা সকলে মিলে আমীরুল মুমিনীনকে হত্যা করে ফেলেছ।
সকল নির্ভরযোগ্য ইতিহাস গ্রন্থে এই ঘটনা সবিস্তারে লিপিবদ্ধ আছে। তারা লেখেছেন, খলীফা ওলিদ হযরত সুলায়মান আ.-এর টেবিল মক্কা মুকাররমা পাঠিয়ে দেন। দুই জন ঐতিহাসিক লেখেছেন, মক্কা মুকাররমা পাঠানোর আগে টেবিলের সাথে লাগানো সকল হীরা-জহরত খোলে নেওয়া হয়। তারপর এই টেবিল ইতিহাসের অন্ধকার গহ্বরে হারিয়ে যায়।
***
এই ঘটনার পর খলীফা ওলিদ আর উঠে দাঁড়াতে পারেননি। কিছু দিন পর তাঁর ইন্তেকাল হয়ে যায়। খলীফা অসুস্থ থাকাকালীন মুগীস আর-রুমী খলীফার ছোট ভাই সুলায়মানের কাছে আমীর মুসা বিন নুসাইরের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ পেশ করেন। তারিক বিন যিয়াদও মুসা বিন নুসাইরের আচরণে সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি সুলায়মানের নিকট মুসা সম্পর্কে কোন অভিযোগ না করলেও সুলায়মান মুসার দুশমন হয়ে গিয়েছিলেন। খলীফা ওলিদ জীবদ্দশায় বড় পুত্রকে তার স্থলাভিষিক্ত করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু লিখিত হুকুমনামা জারি করার কোন ফুরসত তিনি পাননি। সুলায়মান এই সুযোগের ফায়দা উঠিয়ে নিজেই খলীফা হয়ে বসেন এবং খুতবায় তার নাম যুক্ত করে দেন। খলীফা হওয়া মাত্রই সুলায়মান যে কাজটি করেন, তা হল তিনি মুসা বিন নুসাইরকে দরবারে ডেকে পাঠান।
মুসা বিন নুসাইরের আগমনের সংবাদ শুনামাত্রই সুলায়মান বার্তাবাহকের মাধ্যমে এই সংবাদ পাঠিয়ে ছিলেন যে, তিনি যেন তার সাথে নিয়ে আসা হাদিয়া-তোহফা আর গনিমতের মাল খলীফার নিকট পেশ না করেন। কিন্তু মুসা বিন নুসাইর সুলায়মানের কথা শুনেননি। এ কারণে সুলায়মান মুসার প্রতি অসন্তুষ্ট হন। পরবর্তীতে হাদিয়া-তোহফার আধিক্য দেখে সুলায়মানের মনের অসন্তষ্টি দুশমনীর রূপ ধারণ করে। সুলায়মান যখন মুসাকে দরবারে ডেকে পাঠান তখন সেখানে সুলায়মানের আজ্ঞাবহ ও মোসাহেব শ্রেণির লোজন উপস্থিত ছিল।
‘মুসা বিন নুসাইর!’ সুলায়মান বললেন। আজ থেকে তুমি কোন রাজ্যের আমীর নও। তুমি একজন মিথ্যুক, খেয়ানতকারী ও বদদ্বীন লোক।
সুলায়মান ভরা দরবারে টেবিলের ঘটনা সবাইকে শুনান। অতঃপর মুগীস আর-রুমী যে অভিযোগ উত্থাপন করেছেন, তা শুনান এবং নিজের পক্ষ থেকে বেশকিছু অভিযোগ উত্থাপন করে এই হুকুম প্রদান করেন যে, একে কয়েদখানায় নিক্ষেপ করো।’
প্রায় সকল মুসলিম-অমুসলিম ইতিহাসবিদগণ লেখেছেন, মানুষ হিসেবে সুলায়মান বড় ভাই ওলিদের তুলনায় একেবারে উল্টো ছিলেন। ওলিদকে দিনের উজ্জ্বলতার সাথে তুলনা করা হলে সুলায়মানকে তুলনা করা হত নিকষ কালো অন্ধকার রাতের সাথে। সুলায়মানই ছিলেন প্রথম খলীফা যিনি রাজতন্ত্রের বুনিয়াদ স্থাপন করেছিলেন। শরীয়তের বিধান অনুযায়ী উচিত ছিল, মুসা বিন নুসাইরকে আইনের সম্মুখীন করা। শাস্তি বা নিষ্কৃতি–যেটাই তার প্রাপ্য হবে, কাজী সেই ফয়সালা প্রদান করবেন। কিন্তু সুলায়মান ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজ হাতে আইন তুলে নেন এবং মুসা বিন নুসাইরকে কয়েদখানায় পাঠিয়ে দেন। সুলায়মান শুধু এতটুকু করেই ক্ষান্ত হননি। তিনি এই নির্দেশ জারি করেন যে, এই কয়েদিকে এতটা শাস্তি প্রদান করা হোক, যেন তার বেঁচে থাকাই কষ্টকর হয়ে পড়ে, কিন্তু মৃত্যুবরণও যেন না করে।