খলীফা ওলিদের চেহারার রং তৎক্ষণাৎ পাল্টে গেল। ধীরে ধীরে সেখানে গোসার চিহ্ন ফুটে উঠল। খলীফা ওলিদ তারিক বিন যিয়াদের উপর রাগান্বিত হয়ে পড়েন। তিনি মনে করেছেন, তারিক তার আমীরের উপর মিথ্যা কথা বলার অপবাদ আরোপ করেছেন। মুসা বিন নুসাইরের মত প্রবীণ আমীরের উপর ধোঁকাবাজির অভিযোগ কেউ-ই মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না।
‘ইবনে যিয়াদ!’ খলীফা গম্ভীর কণ্ঠে বললেন। তোমার কি এই অনুভূতি নেই যে, তুমি কত বড় ব্যক্তির উপর কতটা নিকৃষ্ট অপবাদ আরোপ করছ? তোমার কি জানা নেই, এই দুঃসাহসের শাস্তি কত ভয়াবহ হতে পারে? তুমি কি এটা প্রমাণ করতে পারবে যে, এই টেবিল আমীর মুসার প্রচেষ্টায় নয়; বরং তোমার প্রচেষ্টায় আমাদের হস্তগত হয়েছে?
‘হ্যাঁ, আমীরুল মুমিনীন!’ তারিক বিন যিয়াদ বললেন। একটি নয়; আমি কয়েকটি প্রমাণ পেশ করতে পারব। আমি সেই সিপাহীদেরকে আপনার সামনে উপস্থিত করতে পারব, যারা এই টেবিল একটি ঘোড়াগাড়ি থেকে উদ্ধার করেছিল। আমি আন্দালুসিয়া থেকে সেসকল পাদ্রিদের ডেকে এনে আপনার সামনে উপস্থিত করতে পারব, যারা এই টেবিল নিয়ে টলেডু থেকে পালিয়ে যাচ্ছিল।
‘আমি তোমাকে এতটা সময় দিতে পারব না। খলীফা ওলিদ বললেন। আমার জীবনের কোন ভরসা নেই। ক’দিন বাঁচব কে জানে? এসকল লোকদের আসতে না জানি কত দিন লেগে যাবে। তোমার কৃতিত্ব আর বিজয়-সাফল্যের কারণে আমি তোমাকে এই সুযোগ দিচ্ছি যে, তুমি তোমার আমীরের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবে, তারপর তোমার দেশে ফিরে যাবে। যদি এটা করতে না পার তাহলে এই অনর্থক অপরাধের শাস্তি ভোগ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাও।’
‘আমি এখানেই একটি প্রমাণ পেশ করতে পারি, আমীরুল মুমিনীনা তারিক বিন যিয়াদ বললেন। এই টেবিলের পায়া চারটি লক্ষ্য করুন। তিনটি পায়া এক রকম, আর চতুর্থটি স্বর্ণ দ্বারা তৈরী। একেবারে সাদামাটা।
খলীফা ওলিদ গভীরভাবে লক্ষ্য করে দেখলেন, তিনটি পায়ায় অত্যন্ত মূল্যবান ও দুর্লভ মণি-মুক্ত আর হীরা-জহরত লাগানো আছে। আর চতুর্থ পায়াটি একেবারেই সাদামাটা।
‘এই টেবিলের চতুর্থ ও আসল পায়া আমার কাছে আছে।’ তারিক বিন যিয়াদ বললেন। আমীর মুসা যখন টলেডু আসেন তখন তিনি সর্বপ্রথম আমাকে আমার লসকরের সামনে চাবুক দিয়ে আঘাত করেন। তারপর আমাকে জেলখানায় নিক্ষেপ করেন। আমীর মুসার এ সকল আচরণ দেখে আমার মনে তার নিয়ত সম্পর্কে সন্দেহ সৃষ্টি হয়। অতঃপর আমি যখন তার সাথে এই টেবিল সম্পর্কে আলোচনা করি তখন তিনি আমাকে নির্দেশ দেন, আমি যেন এই টেবিল তার হাতে সোপর্দ করি। টেবিল আনার জন্য তিনি আমাকে মুক্ত করলে আমি সন্দেহের বশবর্তী হয়ে টেবিলের একটি পায়া খুলে রাখি। তারপর আমীর মুসাকে বলি, এটি অত্যন্ত রহস্যময় টেবিল। এটি যখন আমাদের হস্তগত হয় তখন এর পায়া চারটিই ছিল। এখন একটি পায়া অদৃশ্য হয়ে গেছে। সেদিন আমার মনে যে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছিল আজ আপনার সামনে তা বাস্তব রূপ লাভ করেছে। আমীর মুসা টলেডুতে এর চতুর্থ পায় স্বর্ণ দিয়ে তৈরী করিয়েছিলেন। আপনি অনুমতি দিলে এই টেবিলের আসল পায়াটি এখনই আমি আপনার সামনে পেশ করতে পারি।’
খলীফা ওলিদের অনুমতি নিয়ে তারিক বিন যিয়াদ বের হয়ে এসে অল্পক্ষণের মধ্যেই আবার ফিরে এলেন। তাঁর হাতে টেবিলের আসল পায়াটি দেখা যাচ্ছিল। তিনি মুসা বিন নুসাইরের তৈরীকৃত পায়াটি খোলে আসল পায়া টেবিলের সাথে জোড়ে দিলেন।
‘আমীরুল মুমিনীন!’ মুগীস আর-রুমী বলে উঠলেন। তিনি এখানেই ছিলেন। আমি আমীর মুসা সম্পর্কে আরও কিছু কথা বলতে চাই। এ কথা বলার জন্য আপনার অনুমতি নেওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। ইসলাম এই অনুমতি দিয়ে রেখেছে। স্বয়ং খলীফাও যদি কোন অন্যায় করেন তাহলে রাজ্যের একজন সাধারণ মানুষও তার কাছে জাবাবদিহি করতে পারে।’
‘বল, মুগীস! তুমি যা বলতে চাও, বল।’ খলীফা ওলিদ বললেন।
‘আমীরুল মুমিনীন!’ মুগীস বললেন। আমি মাত্র সাতশ সৈন্য নিয়ে প্রচণ্ড ঝাবিক্ষুব্ধ অন্ধকার রাতে কর্ডোভা শহর দখল করেছিলাম। আশ-পাশের আরও দুটি কসবাও আমি সেই স্বল্পসংখ্যক সৈন্য নিয়ে বিজিত করেছি। সে বিজয়ের কথা আমি আপনার নিকট পরে কখনও বর্ণনা করব। এই বিজয়ের পুরস্কার আমি আল্লাহর কাছ থেকে নেব। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই আমি জিহাদ করেছি। কিন্তু আমীর মুসা আমাকে বলেছেন, তুমি প্রথমে ইহুদি ছিলে, তারপর গোথ সম্প্রদায়ের লোক হয়েছ, অতঃপর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছ। এ জন্য তুমি আরব সালারদের সমান হতে পার না। আমি আপনার সামনে পেশ করার জন্য কর্ডোভার গভর্নরকে আমার ব্যক্তিগত বন্দী হিসেবে নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু দামেস্ক প্রবেশ করার আগে সর্বশেষ যেখানে আমরা যাত্রা বিরতি করেছিলাম, সেখানে আমীর মুসা আমাকে হুকুম দেন, আমি যেন গভর্নরকে তাঁর হাতে সোপর্দ করি এবং এ কথা প্রচার করি, গভর্নর আমার বন্দী নয়; আমীর মুসার বন্দী। আমি এ কথা মানতে অস্বীকার করলে আমীর মুসা নিজ হাজে গভর্নরকে হত্যা করে ফেলেন।
‘আল্লাহর কসম!’ হঠাৎ খলীফার ছোট ভাই সুলায়মান চিৎকার করে বলে উঠেন। আমীর মুসার এই অপরাধ কিছুতেই ক্ষমার যোগ্য নয়। সে তারিকের টেবিল আর মুগীসের বন্দীকে নিজের বলে দাবি করে–এ কথা প্রমাণ করে দিয়েছে যে, সে আন্দালুসিয়ায় যে বিজয় অর্জন করেছে, তা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করেনি; খলীফার সন্তুষ্টি অর্জন করার জন্য করেছে।