‘এটা নির্দেশ নাকি অনুরোধ? মুসা বিন নুসাইর জিজ্ঞেস করলেন।
‘আপনি যা মনে করেন। অশ্বারোহী বলল। ‘আমি আপনার কাছে পয়গাম পৌঁছে দিয়েছি।’
‘সুলায়মানকে আমার সালাম পৌঁছে দেবেন।’ মুসা বিন নুসাইর বললেন। আমি এই পাপের কাজ কখনই করব না যে, খলীফার মৃত্যুর অপেক্ষা করব। তাকে বলে দেবেন, আমি খলীফার নির্দেশে এখানে এসেছি, খলীফার সাথেই দেখা করব। আল্লাহ না-করুন, খলীফার ইন্তেকাল হয়ে গেলে তাঁর বড় ছেলেও খলীফা হতে পারেন। এটা তো জরুরী নয় যে, সুলায়মানই তার স্থলাভিষিক্ত হবেন। সে যাইহোক, বর্তমানে ওলিদ হলেন আমীরুল মুমিনীন। তাঁকে মান্য করা আমার কর্তব্য। যা কিছু দেওয়ার আমি তাকেই দেব। যা কিছু নেওয়ার তাঁর কাছ থেকেই নেব। আমি সবার আগে তার সাথেই সাক্ষাত করব।’
‘আমীর, এমনটি করবেন না। অশ্বারোহী বলল। আপনি আমীরুল মুমিনীনের সাথে সাক্ষাত করবেন না। সুলায়মান তাঁর ভাই। তিনি কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। আমীরুল মুমিনীন অসুস্থ। হেকিম বলেছেন, কেউ যেন তার সাথে সাক্ষাত না করে।’
অশ্বারোহী চলে গেল। মুসা বিন নুসাইর হতাশ হয়ে পড়লেন। তিনি দ্রুত খলীফার সাথে সাক্ষাত করতে চাচ্ছিলেন। আল্লাহ তার ইচ্ছা পূর্ণ করার ব্যবস্থা করলেন। রাজদরবারের এক ব্যক্তি তাকে বলল, ডাক্তারের নিষেধ সত্ত্বেও খলীফা ওলিদ জুমার নামায আদায় করার জন্য মসজিদে আসছেন।
মূলত খলীফা ওলিদ নামায পড়ার জন্য নয়; নামায পড়ানোর জন্য মসজিদের উদ্দেশ্যে বের হয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, আর বেশি দিন তিনি বাঁচবেন না। তিনি শেষ বারের মত ইমামতের সৌভাগ্য অর্জন করতে চাচ্ছিলেন। প্রকৃত অর্থেই খলীফা ওলিদ ছিলেন একজন মর্দে মুমিন। ইসলামের প্রচার-প্রসার ও ইসলামী সাম্রাজ্যের বিস্তারের জন্য তিনি ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। তাঁর অনুমতিতে এবং তাঁরই পৃষ্টপোষকতায় মুহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু আক্রমণ করেছিলেন। তারিক বিন যিয়াদকে আন্দালুসিয়া অভিযানের অনুমতিও তিনি দিয়েছিলেন এবং এ ব্যাপারে সবধরনের সহযোগিতা প্রদান করেছিলেন।
***
মুসা বিন নুসাইর যখন জানতে পারলেন যে, খলীফা ওলিদ জুমার নামায আদায়ের জন্য মসজিদের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন তখন তিনি নির্দেশ দিলেন, যেসকল উপহার-উপঢৌকন খলীফার জন্য আনা হয়েছে সেগুলো মসজিদে নিয়ে যাও। মুসা বিন নুসাইর মসজিদে এসে খলীফার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর খলীফা মসজিদে উপস্থিত হলেন। মুসা খলীফার সাথে সাক্ষাত করলেন। তারিক বিন যিয়াদ আর মুগীস আর-রুমীও খলীফার সাথে সাক্ষাত করেন। আনন্দের আতিশায্যে খলীফা আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন।
নামাযের পর মুসা খলীফা ওলিদের সামনে মসজিদেই উপহার সামগ্রী ও গনিমতের মাল প্রদান করেন। বিপুল পরিমাণ মহামূল্যবান দ্রব্যসামগ্রী দেখে খলীফার চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেল। অন্যরা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। খাঁটি স্বর্ণের এত বিপুল পরিমাণ দ্রব্যসামগ্রী তারা কখনও দেখেনি।
খলীফার ভাই সুলায়মান সেখানেই উপস্থিত ছিলেন। তাঁর চেহারায় সুস্পষ্টরূপে ক্রোধের চিহ্ন পরিলক্ষিত হচ্ছিল। তিনি এমনভাবে মুসা বিন নুসাইরের দিকে তাকাচ্ছিলেন যে, মনে হচ্ছিল, সুযোগ পেলে তিনি মুসাকে জীবন্ত কবর দিয়ে দেবেন। এসকল উপহারসামগ্রী দিয়েই তো তিনি তাঁর মহল সাজাতে চেয়েছিলেন। তাই তো তিনি মুসা বিন নুসাইরের নিকট পয়গাম পাঠিয়েছিলেন, কয়েক দিন অপেক্ষা করার জন্য। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল খলীফা ওলিদ অল্প কয়েক দিনের মেহমান মাত্র।
মুসা বিন নুসাইর উপহারের একেকটি বস্তু বের করছিলেন আর তার বিবরণ দিচ্ছিলেন। অবশেষে তিনি সেই টেবিলটি বের করলেন, যেটি টলেডু বিজিত হওয়ার পর তারিক বিন যিয়াদের হস্তগত হয়েছিল। তারিক বিন যিয়াদ পলায়নপর কয়েকজন পাদ্রি থেকে এই টেবিলটি উদ্ধার করেছিলেন। কথিত আছে, এটি হযরত সুলায়মান আ.-এর টেবিল।
‘আমীরুল মুমিনীন! মুসা বিন নুসাইর বললেন। আমি এই টেবিলটি টলেডুর পাদ্রিদের থেকে অনেক কষ্ট করে অর্জন করেছি। বিশেষ করে আপনার জন্য এটি আমি নিয়ে এসেছি। এই টেবিলের সাথে যেসকল মণি-মুক্তা আর হীরা-জহরত লাগানো আছে, আজকাল সেগুলো কোথাও পাওয়া যায় না। এটি হযরত সুলায়মান আ.-এর মালিকানাধীন ছিল। কেউ বলতে পারে না, এটি কীভাবে আন্দালুসিয়া এসেছে।’
খলীফা ওলিদ চতুর্দিক থেকে ঘুরে ঘুরে টেবিলটি দেখছিলেন। তার চেহারায় আনন্দের ছাপ যতটুকু পরিলক্ষিত হচ্ছিল, তার চেয়েও বেশি বিস্ময়ের চিহ্ন ফুটে উঠছিল। হযরত সুলায়মান আ.-এর সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার কারণে খলীফা ওলিদ এটিকে পবিত্র মনে করছিলেন।
ইবনে নুসাইর! খলীফা ওলিদ বিস্ময়াভিভূত কণ্ঠে বলে উঠলেন। আমার জন্য তুমি যে হাদিয়া এনেছ, কেউ তার মূল্য পরিশোধ করতে পারবে না। এই টেবিলের কথা কী আর বলব! তুমি নিজেই বল, তোমাকে কী পুরস্কার দেব?
‘আমীরুল মুমিনীন! তারিক বিন যিয়াদ বলে উঠলেন। তিনি পাশে দাঁড়িয়ে মুসা বিন নুসাইরের কথা শুনছিলেন, আর মনে মনে দগ্ধ হচ্ছিলেন। এই পুরস্কারের হঙ্গার আমি। এই টেবিল আমীর মুসা অর্জন করেননি, বরং আমার মুজাহিদগণের কৃতিত্ব এই যে, তারা এই টেবিল হস্তগত করতে সক্ষম হয়েছেন। আমীর মুসা এই টেবিল আমার কাছ থেকে হুকুম বলে নিয়ে নিয়েছেন।