‘না, তোমার সেই অধিকার নেই।’ মুসা বিন নুসাইর বললেন। তোমার সেই অনুভূতিও নেই যে, আমি তোমাকে কী পরিমাণ সম্মানিত করেছি, অথচ তুমি এই সম্মানের যোগ্য ছিলে না। তুমি ইহুদি ছিলে, তারপর গোথ হয়েছ, অতঃপর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছ। তুমি ছিলে দ্বিতীয় শ্রেণির সালার। আমি তোমাকে আরবী সালারদের সমমর্যাদা দান করেছি।’
‘ইসলাম মানুষের মাঝে জাত-পাতের বিভক্তি সৃষ্টি করে না। মুগীস: বললেন। এ কারণেই আমি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছি। আপনি যতটা ইচ্ছা আমাকে লাঞ্ছিত করতে পারেন, করেন। তবে মনে রাখবেন, আমি একবার যখন মুসলমান হয়েছি, তখন আজীবন মুসলমানই থাকব। মুসলমান হয়েই মৃত্যু বরণ করব। সম্মানিত আমীর, আমি আপনাকে স্পষ্ট করে বলতে চাই, আমার কয়েদি আমি আপনাকে দেব না।’
মুসা তার একজন দেহরক্ষীকে ডেকে বললেন, “কর্ডোভার খ্রিস্টান গভর্নরকে এখানে নিয়ে এসো। দেহরক্ষী গভর্নরকে নিয়ে আসল।
‘এই লোকই তো তোমার কয়েদি-না? মুসা বিন নুসাইর জিজ্ঞেস করলেন।
হ্যাঁ, এই লোকই।’ মুগীস বললেন।
মুসা বিন নুসাইর বন্দী গভর্নরের পিছন দিকে চলে এলেন। তারপর হঠাৎ কোষ থেকে তরবারী বের করে গভর্নরের গর্দান লক্ষ্য করে এমন সজোরে আঘাত হানলেন যে, তার দেহ থেকে মাথা আলাদা হয়ে মাটিতে ছিটকে পড়ল। দেহটা কিছুক্ষণ ছটফট করে নিথর হয়ে গেল।
মুগীস আর-রুমী আর তারিক বিন যিয়াদ কোন কথা না বলে ঘটনাস্থল ছেড়ে চলে গেলেন।
***
কাফেলা আবার দামেস্কের উদ্দেশ্যে চলতে শুরু করল। তারিক বিন যিয়াদ আর মুগীস আর-রুমী মুসা বিন নুসাইরের সামনে থেকে চলে এসে একত্রে পথ চলছিলেন। তারা উভয়ে দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে সামনে অগ্রসর হচ্ছিলেন। তাদের মনের কষ্ট চেহারায় সুস্পষ্টরূপে ফুটে উঠেছিল।
‘ইসলামে এজন্যই রাজকীয় জাঁকজমক নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যাতে আমীরের মন-মস্তিষ্কে দম্ভ-অহংকার সৃষ্টি হতে না পারে। তারিক বিন যিয়াদ বললেন। লক্ষ্য করে দেখ, এতো বয়োবৃদ্ধ, এতো বুদ্ধিমান একজন মানুষের দিল-দেমাগে বাদশাহীর জাঁকজমক কী প্রভাব সৃষ্টি করেছে!
‘আরেকটি বিষয়ে আমার সন্দেহ হচ্ছে।’ মুগীস বললেন। আবদুল আযীযের খ্রিস্টান স্ত্রী বৃদ্ধের দেমাগ বিগড়ে দেওয়ার জন্যই এমন রাজকীয় অভ্যর্থনার ব্যবস্থা করেছিল।’
মুসা বিন নুসাইর স্বীয় পুত্র আবদুল আযীযকে আন্দালুসিয়ার আমীর নিযুক্ত করেছিলেন। কায়রোয়ান এসে তিনি তার দ্বিতীয় পুত্র আবদুল্লাহকে আফ্রিকার পূর্ব দিকের প্রশাসক নিযুক্ত করেন। পশ্চিম দিকের দায়িত্ব তৃতীয় ছেলে আবদুল মালেকের হাতে ন্যস্ত করেন। বাদবাকি এলাকার দায়িত্ব অর্পণ করেন সবচেয়ে ছোট ছেলে মারওয়ানের উপর।
এই বৃদ্ধ আমীর আন্দালুসিয়ায় ও আফ্রিকায় তাঁর পারিবারিক বাদশাহী কায়েম করেছেন। তারিক বিন যিয়াদ বললেন। এখন তিনি আমিরুল মুমিনীনের কাছ থেকে তাঁর পুত্রদের নিযুক্তির ব্যাপারে অনুমোদন আদায় করবেন। কোন একজন বার্বারকে যদি তিনি কোন এক অঞ্চলের প্রশাসক নিযুক্ত করতেন তাহলে আমাদের মন খুশী হয়ে যেত।
‘আপনার সেই টেবিলটিও তিনি হাতিয়ে নিয়েছেন। মুগীস বললেন। দেখবেন, তিনি আমীরুল মুমিনীনকে বলবেন, এটি হযরত সুলায়মান আ.-এর টেবিল। অত্যন্ত কষ্ট করে তিনি এটি অর্জন করেছেন।’
‘তিনি সত্যিই যদি এমনটি করেন তাহলে তাকে সকলের সামনে শরমিন্দা হতে হবে। তারিক বিন যিয়াদ বললেন। আমি এজন্য সব ধরনের ব্যবস্থা করে রেখেছি।’
তারিক বিন যিয়াদ ও মুগীস আর-রুমী যদিও মুসা বিন নুসাইরের শত্রু হয়ে যাননি, তথাপি তিনি তাদেরকে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ রাখতে সক্ষম হননি।
***
পূর্বেই দামেস্কে এ সংবাদ প্রচারিত হয়ে গিয়েছিল যে, আন্দালুসিয়ার বিজেতাগণ আগমন করছেন। তাদের সাথে আসছে অসংখ্য যুদ্ধবন্দী, যুদ্ধলব্ধ দাস-দাসী, আর বিপুল পরিমাণ গনিমতের মাল। কাফেলা পৌঁছার সংবাদ শুনা মাত্রই দামেস্কের ছোট-বড় সকলেই মুসলিম বাহিনীকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য শহর থেকে বের হয়ে এলো। তারা শ্লোগানে শ্লোগানে মুসলিম বাহিনীকে সাদর সম্ভাষণ জানাতে লাগল। কাফেলা শহরে প্রবেশ করতেই পুরবাসিনী নারীগণ দরজা-জানালা খোলে এবং বাড়ির ছাদে উঠে হাত নেড়ে খোশ আমদেদ জানাতে লাগলেন।
মুসা বিন নুসাইরের কাফেলা বিশাল বিস্তৃত এক ময়দানে এসে অবস্থান গ্রহণ করল। উটগুলোকে বসিয়ে সামানপত্র নামানো হচ্ছিল, এমন সময় একজন অশ্বারোহী ঘোড়া থেকে নেমে মুসা বিন নুসাইরের সামনে এসে দাঁড়াল। আগন্তুক মুসা বিন নুসাইরকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে একটি পয়গাম গুনাল। তখন এই পয়গামের কথা অন্য কেউ হয়তো শুনেনি; কিন্তু ইতিহাসের পাতায় সেই পয়গামের কথা আজও লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। সেই পয়গাম ছিল খলীফা ওলিদ বিন আবদুল মালেকের তাই সুলায়মান বিন আবদুল মালেকের পক্ষ থেকে। সুলায়মান বিন আবদুল মালেকের মর্যাদা হল তিনি খলীফার ছোট ভাই। পয়গাম নিয়ে আসা ব্যক্তি সুলায়মানের খাস লোক।
‘সুলায়মান বিন আবদুল মালেক আপনার জন্য পয়গাম পাঠিয়েছেন।’ অশ্বারোহী বলল। তিনি বলেছেন, আমিরুল মুমিনীন খুবই নাযুক অবস্থায় আছেন, যে কোন সময় তিনি ইন্তেকাল করতে পারেন। আপনি তার সাথে সাক্ষাত করবেন না এবং কোন হাদিয়া ও গনিমতের মাল তাঁকে দেবেন না। কয়েক দিন অপেক্ষা করুন। তার ইন্তেকালের পর সুলায়মান আমীরুল মুমিনীন হবেন। তখন তাঁর নিকট সকল হাদিয়া, দাসী-বান্দি ও গনিমতের মাল পেশ করবেন।’