‘তাহলে কি আপনি আন্দালুসিয়া ও আমাদের মাঝে একজন স্বাধীন রাজা হয়ে থাকতে চান?’ মুসা বিন নুসাইর জুলিয়ানকে জিজ্ঞেস করলেন।
‘আপনার এই প্রশ্নের উত্তর পরেও দেওয়া যাবে। জুলিয়ান বললেন। আগে আপনি আমার একটি প্রশ্নের উত্তর দিন। আন্দালুসিয়ার মতো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যেভরা সুজলা-সুফলা রাজ্যকে আপনার বিশাল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করার কোন চিন্তা কি আপনার আছে?
‘না.. আন্দালুসিয়ার উপর হামলা করার মতো সৈন্যবাহিনী আমার নেই।’ মুসা বিন নুসাইর বললেন। তাছাড়া আন্দালুসিয়ার বিশাল সৈন্যবাহিনীর সাথে। লড়াই করার জন্য রসদ সংগ্রহ করাও আমার পক্ষে অসম্ভব।
এটা ছিল মুসা বিন নুসাইরের একটি কুটনৈতিক চাল। তিনি প্রতিপক্ষকে তার ইচ্ছা ও শক্তি সম্পর্কে বেখবর রাখতে চাচ্ছিলেন। তিনি কথার প্যাঁচে ফেলে জুলিয়ানের আগমন-রহস্য উদ্ধার করতে চাচ্ছিলেন।
প্রকৃত সত্য হল, মুসা বিন নুসাইর কয়েকবারই সমুদ্র অতিক্রম করে আন্দালুসিয়া আক্রমণ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। এ ব্যাপারে তিনি তার অভিজ্ঞ সালারদের সাথে পরামর্শও করেছেন। খলীফার ইজাযতের জন্য চেষ্টাও চালিয়েছিলেন।
খলীফার ইজাযত নেওয়া তাঁর পক্ষে কোন কঠিন কাজ ছিল না। কারণ, খলীফা ওলিদ বিন আবদুল মালেক অমুসলিম রাজ্যে আক্রমণ করার পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি মুহাম্মদ বিন কাসেমকে হিন্দুস্তান আক্রমণের জন্য পাঠিয়ে ছিলেন। তথাপি মুসা বিন নুসাইরের মনে সামান্য দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল। কারণ, তিনি জানতেন আরবদের এখনও সরাসরি কোন নৌযুদ্ধের অভিজ্ঞতা হয়নি। আরব মুজাহিদগণ কিস্তি চালনার ক্ষেত্রে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন ঠিক; কিন্তু স্থলযুদ্ধের তুলনায় নৌযুদ্ধের কলা-কৌশল অনেকটা ভিন্ন হয়ে থাকে। সে ব্যাপারে আরব মুজাহিদদের এখনও পর্যন্ত কোন প্রত্যক্ষ ধারণা জন্মেনি।
আফ্রিকা থেকে আন্দালুসিয়া আক্রমণ করতে হলে একমাত্র সমুদ্রপথেই অগ্রসর হতে হবে। এই সমুদ্রপথে আন্দালুসিয়া আক্রমণ করা হলে আন্দালুসিয়ার বিশাল নৌবহর নিশ্চিতরূপে বাধা প্রদান করবে। এই বাধা অতিক্রম করা মুসলমানদের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব।
মুসা বিন নুসাইর জুলিয়ানের প্রশ্নের উত্তরে বললেন, আন্দালুসিয়া আক্রমণ করার আদৌ কোন ইচ্ছা তার নেই। তিনি সন্দেহ করছিলেন, হয়তো জুলিয়ান এ জন্য এসেছে যে, মুসলমানগণ আন্দালুসিয়ার ব্যাপারে কী ধরনের চিন্তা-ভাবনা করছেন, তা জানার জন্য। তাঁর মনে এই সন্দেহও উঁকি দিচ্ছিল যে, জুলিয়ান হয়তো দেখতে এসেছেন, মুসলমানগণ কী করছে? তারা যদি বিলাসপ্রবণ হয়ে যুদ্ধ থেকে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকে তাহলে অতর্কিত হামলার মাধ্যমে মিসর ও আফ্রিকা থেকে চিরতরে তাদেরকে উচ্ছেদ করা হবে।
এসব কথা চিন্তা করেই মুসা বিন নুসাইর এমনভাবে কথা বলছিলেন, যেন মুসলমানদের পরিকল্পনা ও শক্তি-সামর্থ সম্পর্কে জুলিয়ান কোন ধরনের ধারণা অর্জন করতে সক্ষম না হয়।
অপরদিকে জুলিয়ানের আগমনের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল, মুসা বিন নুসাইরকে আন্দালুসিয়া আক্রমণের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করা। তাই তিনি আন্দালুসিয়ার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ভৌগোলিক গুরুত্বের কথা চিত্তাকর্ষক ও হৃদয়গ্রাহী ভাষার মাধ্যমে তুলে ধরছিলেন।
‘সম্মানিত আমীর! আপনি হয়তো জানেন না, আন্দালুসিয়া কুদরতের অপূর্ব সৃষ্টি-শৈলীর এক আশ্চর্য নিদর্শন। সবুজ পাহাড় আর মনোমুগ্ধকর উপত্যকায় ঘেরা অনিন্দ্য সুন্দর এক মুলুক। চতুর্দিকে সবুজের সমারোহ। দিগন্ত বিস্তৃত শস্যের সবুজ আভায় উদ্ভাসিত ফসলের মাঠ। পত্র-পুষ্পে আচ্ছাদিত ঘন বৃক্ষরাজির চোখ জোড়ানো দৃশ্য, আর সবুজের বুক চিরে কুলকুল তানে বয়ে চলা অসংখ্য নদ-নদী। মাটির উপর মাঠ ভরা সোনালী ফসল, আর মাটির নিচে থরে থরে সাজানো অসংখ্য খনিজ সম্পদ।
আপনি একবার সেখানে গেলে আর কখনও আরবের বালুকাময় মরুর দেশে ফিরে যেতে ইচ্ছা করবেন না। ফিরে আসতে চাইবেন না আফ্রিকার এই কঙ্করময় মরু ভূমিতেও।
সেখানের মানুষ সুন্দর। সেখানের মেয়েরা পাগলকরা রূপ-সৌন্দর্যের অধিকারিনী। আপনি জান্নাতের হুর-পরীদের সৌন্দর্যের কথা শুনেছেন, যা শুধু মৃত্যুর পরই দেখা যাবে। জানা নেই, কে সেই সৌন্দর্য ভোগ করতে পারবে, আর কে পারবে না। কিন্তু আন্দালুসিয়া গেলে আপনি দ্বিধাহীন কণ্ঠে বলতে বাধ্য হবেন। এই সেই জান্নাত, আল্লাহ যার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।’
জুলিয়ান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে মুসা বিন নুসাইরকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘আফ্রিকার আমীর, আপনি কী ভাবছেন? আন্দালুসিয়ার প্রবেশদারের চাবি আমার হাতে, আমি সেই চাবি আপনার হাতে তুলে দেব।
জুলিয়ান আন্দালুসিয়ার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এমনি হৃদয়গ্রাহী উপস্থাপনার মাধ্যমে তুলে ধরছিলেন যে, মুসা বিন নুসাইর আন্দালুসিয়ার সৌন্দর্যে মোহবিষ্ট হয়ে পড়ছিলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন বয়োবৃদ্ধ ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তি। ইহুদি-নাসারাদের জাদুময়ী বাক-চাতুর্য ও চিত্তাকর্ষক ষড়যন্ত্র সম্পর্কে তিনি ভালোভাবেই অবগত ছিলেন।
তিনি ইঙ্গিতে নিজের লোকদের এবং জুলিয়ানের সাথে আগত মেহমানদেরকে দরবারকক্ষ থেকে বাইরে যেতে বললেন। দরবারকক্ষে থাকলেন শুধু মুসা বিন নুসাইর, জুলিয়ান আর দোভাষী।