এই কাফেলায় প্রায় ত্রিশ হাজার যুদ্ধবন্দী ছিল। ঘোড়াগাড়িতে করে শত-সহস্র দাসী-বান্দি নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। এদের সকলেই ছিল আন্দালুসিয়ার অধিবাসী। তারা মুসলমানদের সাথে দামেস্ক যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছিল। নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ও আমীর-উমারাদের স্ত্রী-কন্যারা তাদের স্বামীদের সাথে দামেস্ক যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলে, তাদেরকেও সাথে নেওয়া হল। ইতিহাসবিদগণ তাদের সকলের রূপ-সৌন্দর্যের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।
মালে গনিমতের পরিমাণ এত বেশি ছিল যে, কয়েক হাজার খচ্চরের উপর সেগুলো বোঝাই করা হয়েছিল। সেগুলোর মধ্যে তলোয়ার, বর্শা, তীর-ধনুকসহ ছোট-বড় সবরকম যুদ্ধসামগ্রী ছিল। মোটকথা, মুসা বিন নুসাইরের কাফেলার শান-শওকত আর জাঁকজমক যে কোন রাজা-বাদশাহর জন্যও ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। স্বয়ং মুসা বিন নুসাইরও এই জাঁকজমক দেখে প্রভাবিত হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর কথাবার্তা আর চাল-চলনে আত্মঅহমিকা ফুটে উঠেছিল।
কয়েক দিন পর কাফেলা জাবালুত তারিকের সদ্র বন্দরে এসে পৌঁছে। এখানে বড়সড় কয়েকটি জাহাজ আর মালবাহী কিস্তি প্রস্তুত করে রাখা হয়েছিল। এখানেও হাজার হাজার লোক মুসা বিন নুসাইরকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য উপস্থিত হয়েছিল। আন্দালুসিয়ার অসংখ্য নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ মুসা বিন নুসাইরকে আল-বিদা জানানোর জন্য জাবালুত তারিক পর্যন্ত এসেছিলেন। তারা যেভাবে মাথা উঁকিয়ে আর তোষামোদ করে মুসা বিন নুসাইরকে বিদায় জানাচ্ছিলেন তাতে করেও মুসা বিন নুসাইরের চিন্তা-চেতনায় অহংবোধ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল। কোন মানুষই পূজনীয় নয়–ইসলামের এই মৌলিক বিশ্বাস সেদিন চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছিল।
বিশাল বড় এই কাফেলা মিসরের সমুদ্র তীরবর্তী শহর কায়রোয়ান এসে যাত্রা বিরতি করল। সেসময় কায়রোয়ান ছিল মিসরের রাজধানী। দু-এক দিন কাফেলা এখানে অবস্থান করে দামেস্কের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল। কায়রোয়ান থেকে আরব বংশভোত নেতৃবর্গ ও বার্বার সরদারগণ এবং মিসরের নেতৃস্থানীয় লোকজন কাফেলার অন্তর্ভুক্ত হলেন।
“তারিখে উন্দুলুস’ নামক গ্রন্থে বেশ কয়েকজন ইতিহাসবিদের বরাত দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মিসর ও আফ্রিকার সরদার ও সালারগণ মুসা বিন নুসাইরকে এমনভাবে ঘিরে রেখেছিল যে, মনে হচ্ছিল, তারা তাঁর চার পাশে মানব ঢাল তৈরী করে রেখেছেন। তাদের সকলের আচরণই ছিল দাসত্বসূলভ।
গনিমতের মাল ও উপহার-উপঢৌকনের সামগ্রী ঘোড়া ও খচ্চরের উপর বহন করে জাবালুত তারিক পর্যন্ত আনা হয়েছিল। সেখান থেকে জাহাজ ও কিস্তির মাধ্যমে কায়রোয়ান আনা হয়েছে। কায়রোয়ান থেকে সেগুলো উটের উপর বোঝাই করে দামেস্ক নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বোঝা বহনকারী উটগুলোকে রঙবেরঙের কাপড় দিয়ে সাজানো হয়েছে।
কোন ঐতিহাসিকই লেখেননি যে, এই কাফেলা কতদিন পর দামেস্ক এসে পৌঁছে। কায়রোয়ান থেকে দামেস্কের দূরত্ব ছিল কমপক্ষে তিন মাসের। মুসা বিন নুসাইর যেদিন দামেস্ক এসে পৌঁছেন সেদিন ছিল শুক্রবার। তাঁর আগমনের অব্যবহতি পরই দামেস্কের জামে মসজিদে জুমার নামাযের আযান শুরু হয়।
তারিক বিন যিয়াদ আর মুগীস আর-রুমী কাফেলার পিছন দিকে ছিলেন। তারা পাশাপাশি ঘোড়ায় চড়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন। দূর থেকে দামেস্ক শহর দেখা যাচ্ছিল। তারিক বিন যিয়াদ ও মুগীসের চেহারায় অসম্ভষ্টির ছাপ সুস্পষ্ট পরিলক্ষিত হচ্ছিল। দামেস্ক থেকে কয়েক মনযিল দূরে মুসা বিন নুসাইর এমন এক নাটকীয় ঘটনার জন্ম দেন, যা কেউ চিন্তাও করতে পারেনি। ঘটনার আকস্মিকতায় সকলেই অবাক হয়ে যান। মুসা বিন নুসাইরের মতো বয়োবৃদ্ধ মর্দে মুমিনের এ কী হয়ে গেল, তিনি এমন কেন করলেন?
খেলাফতে উন্দুলুস’ নামক গ্রন্থে এ ঘটনার বিবরণ এভাবে এসেছে :
‘সর্বশেষ যাত্রা বিরতির পর কাফেলা সকাল সকাল রওনা হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। মুসা বিন নুসাইর চাচ্ছিলেন, জুমার নামাযের আগেই দামেস্ক গিয়ে পৌঁছতে। কাফেলা রওনা হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে মুসা বিন নুসাইর মুগীস আর-রুমীকে ডেকে পাঠান। তারিক বিন যিয়াদ সেখানে পূর্ব থেকেই উপস্থিত ছিলেন। মুগীস উপস্থিত হলে মুসা বিন নুসাইর তাকে লক্ষ্য করে বললেন,
‘মুগীস, তোমার সেই বন্দীকে আমার হাতে সোপর্দ করো। তোমার বন্দী খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। সে কর্ডোভার গভর্নর ছিল। আমি নিজে তাকে আমীরুল মুমিনীনের কাছে সোপর্দ করতে চাই।’
‘সম্মানিত আমীর।’ মুগীস বললেন। সে তো আমার বন্দী, আমি কর্ডোভার যুদ্ধে জীবনবাজি রেখে তাকে বন্দী করেছি। আপনিও আমাকে অনুমতি দিয়েছেন, আমি যেন নিজ হাতে তাকে খলীফার দরবারে পেশ করি …।
‘আমি তোমাকে বলছি, এই বন্দীকে আমার হাতে সোপর্দ করো।’ মুসা বিন নুসাইর রাজকীয় ভাবগাম্ভির্যের সাথে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন।
“ঠিক আছে, তবে আমি অবশ্যই আমিরুল মুমিনীনকে বলব, সেই গভর্নরকে আমি গ্রেফতার করেছি।’ মুগীস আর-রুমী বললেন। আমিরুল মুমিনীনকে আমি এ কথাও বলব যে, কত অল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে জীবনবাজি রেখে আমি কর্ডোভা শহর দখল করেছি।’
আমি তোমাকে খলীফার সামনে উপস্থিত হতে দেব না।’ মুসা বিন নুসাইর বললেন।
‘কেন?’ মুগীস জিজ্ঞেস করলেন। আমি কি কোন রণাঙ্গনে পৃষ্ট প্রদর্শন করেছি? আপনি আঠার হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনীর মাধ্যমে যে বিজয় অর্জন করেছেন, আমি মাত্র এক হাজার সৈন্যের মাধ্যমে সেই পরিমাণ বিজয় অর্জন করেছি। তারপরও আমার এতটুকু অধিকারও কি নেই যে, আমি আমিরুল মুমিনীনের সাথে সাক্ষাত করতে পারব?