শহরের প্রধান ফটকের সামনে মুসা বিন নুসাইরকে যে অভ্যর্থনা প্রদান করা হয় এক কথায় তা ছিল অভাবনীয় ও অতুলনীয় এক অভ্যর্থনা। শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ আর মুসলমানগণ এক কাতারে দাঁড়ানো ছিল। মুসা বিন নুসাইর, তারিক বিন যিয়াদ ও মুগীস আর-রুমীসহ অন্যান্য সালারগণ ঘোড়া থেকে নেমে এলেন। মুসলমান ব্যক্তিবর্গ স্বাভাবিকভাবে তাঁদের সাথে মোসাফাহা করেন। কিন্তু আন্দালুসিয়ার অধিবাসীরা প্রথমে মাথা ঝুঁকিয়ে কুর্নিশ করে, তারপর মুসা বিন নুসাইরের হাত তাদের হাতের মধ্যে নিয়ে শ্রদ্ধাভরে চুমু খেতে থাকে। তারিক বিন যিয়াদসহ অন্যান্য সালারদেরকে সাধারণভাবেই অভ্যর্থনা প্রদান করা হয়। মোটকথা, এজেলুনা মুসা বিন নুসাইরকে আন্দালুসিয়ার অন্যান্য বাদশাহদের মতোই একজন বাদশাহ বানিয়ে দেয়।
***
‘প্রিয়। রাতে এজেলুনা আবদুল আযীযকে লক্ষ্য করে বলল। আমি এ কথা ভেবে আশ্চর্য হচ্ছি যে, তুমি নিজেকে এবং তোমার মহান পিতাকে একজন সাধারণ মানুষ কেন মনে কর? তোমার পিতা হলেন, শাহানশা আর তুমি হলে শাহজাদা। আমি তোমার পিতাকে শাহানশার মর্যাদা দিতে চাই।’
এজেলুনা সম্পর্কে সকল ইতিহাসবিদই লেখেছেন, এতে কোন সন্দেহ নেই যে, এই নারী অসাধরণ রূপ-যৌবনের অধিকারী ছিল। কিন্তু সেই সময়ে তার চেয়েও অনেক বেশি রূপসী নারী ছিল। তারপরও এজেলুনার মাঝে এমন কী জাদু ছিল যে, সে রডারিকের মতো পাষাণ হৃদয় বাদশাহকে মোমের মতো বানিয়ে ফেলেছিল, আর আবদুল আযীযের মতো বিচক্ষণ মর্দেমুমিন সালারকে তার হাতের পুতুলে পরিণত করেছিল?
ইতিহাসবিদদের বিবরণ থেকে বুঝা যায়, এজেলুনার আসল জাদু ছিল তার মুখের কথায় আর শরীরের অঙ্গ-ভঙ্গিতে। তার কথার জাদু আর মোহনীয় অঙ্গ-ভঙ্গিই মুসা বিন নুসাইরের মতো বিচক্ষণ ব্যক্তিকে প্রভাবিত করে ফেলেছিল।
ইতিহাসে যে নারীকে সবচেয়ে বেশি সুন্দরী মনে করা হয়, সেই ক্লিওপেট্রীও খুব বেশি সুন্দরী ছিল না। তার সেবিকাদের মধ্যে তার চেয়েও বেশি রূপসী ও আকর্ষণীয় দেহসৌষ্টবের অধিকারিনী নারী ছিল। ক্লিওপেট্রার মাঝে যে সম্মোহনী শক্তি ছিল অন্য কোন নারীর মাঝে তা ছিল না। ক্লিওপেট্রার কুটকৌশল আর ষড়যন্ত্রের সামনে জুলিয়াস সিজারের মতো যোদ্ধাও নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল। জুলিয়াস সিজারের স্থলাভিষিক্ত এ্যান্থনি মিসর আক্রমণ করলে ক্লিওপেট্রা তার মোকাবেলায় সৈন্যবাহিনী না পাঠিয়ে তাকে ভালোবাসার জালে এমনভাবে জড়িয়ে ফেলে যে, তার বিবেক-বুদ্ধি লোপ পেয়ে যায় এবং সে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়। ক্লিওপেট্রার মতো এজেলুনার মাঝেও হয়তো এমনই কোন সম্মোহনী শক্তি ছিল।
মুসা বিন নুসাইর এ্যাশবেলিয়ায় বেশি দিন অবস্থান করেননি। তিনি পুত্র আবদুল আযীযকে আন্দালুসিয়ার আমীর নিযুক্ত করে তার উপর সকল দায়-দায়িত্ব অর্পণ করে দামেস্কের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে পড়েন।
মুসা বিন নুসাইর যেদিন আবদুল আযীযকে আন্দালুসিয়ার আমীর নিযুক্ত করেন সেদিনটিই ছিল এজেলুনার জীবনে সবচেয়ে আনন্দের দিন। এজেলুনা যখন রডারিকের বিবি ছিল তখনও তার জীবনে এমন আনন্দময় কোন দিন আসেনি। সে রডারিকের কাছে পরম প্রিয় ছিল ঠিকই, কিন্তু রানীর মর্যাদা রডারিক অন্য বিবিকে দিয়ে রেখেছিল। তাই সে কোন দিনই রানীর মতো ইচ্ছা-স্বাধীন ছিল না। আজ সে আবদুল আযীযের বিবি হওয়ার সুবাদে রানী যেমন হয়েছে, তেমনি নিজের ইচ্ছা বাস্তবায়নের স্বাধীনতা লাভ করেছে।
***
গনিমতের যে অংশ বায়তুল মালের জন্য বরাদ্ধ ছিল মুসা বিন নুসাইর তা সাথে করে নিয়ে যেতে চাচ্ছিলেন। বেশ কিছু মূল্যবান তোহফা খলীফার জন্য বরাদ্ধ করা হয়েছিল। এ্যাশবেলিয়ার যুদ্ধবন্দীও একেবারে কম ছিল না। যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে রাজ্যের উচ্চপদস্থ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাও ছিল। সকলকে দামেস্ক নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত করা হল।
অবশেষে একদিন মুসা বিন নুসাইর এ্যাশবেলিয়া থেকে জাবালুত তারিকের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলেন। দূরত্ব ছিল তিনশ মাইলেরও কিছু বেশি। পথে বেশ কয়েকটি ছোট-বড় শহর পড়ে। মুসা বিন নুসাইরের কাফেলা যে শহরের নিকট দিয়ে অতিক্রম করত, সে শহরের অধিবাসীরা রাস্তার উভয় পার্শ্বে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে অভ্যর্থনা জানাত। দূর থেকে খোশ আমদেদ আর জিন্দাবাদের ধ্বনী শুনা যেত। পথে পথে মুসা বিন নুসাইরকে লক্ষ্য করে ফুলের পাপড়ী ছিটিয়ে দেওয়া হত।
চলার পথে মুসা বিন নুসাইরের কাফেলাকে এমন উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানোর ব্যবস্থা এজেলুনাই করেছিল। সে মুসা বিন নুসাইরের যাত্রাপথে অবস্থিত সকল শহরের প্রশাসকদের নিকট নির্দেশ পাঠিয়ে ছিল যে, প্রত্যেক শহরের অধিবাসীরা শহর থেকে বাইরে এসে মুসা বিন নুসাইরকে যেন অভ্যর্থনা জানায়।
মুসা বিন নুসাইরের এই বিশাল জাঁকজমকপূর্ণ কাফেলার উদ্দেশ্য সম্পর্কে ইতিহাসবিদগণ লেখেছেন। মুসা বিন নুসাইর চাচ্ছিলেন, খলীফা ওলিদ বিন আবদুল মালেকের দরবারে আন্দালুসিয়ার শান-শওকত ও জাকজমকের পূর্ণ চিত্র তুলে ধরতে। তিনি খলীফার দরবারে এ বিষয়টি তুলে ধরতে চাচ্ছিলেন যে, তিনি শুধুমাত্র একটি রাজ্যই জয় করেননি; বরং সেখানকার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের হৃদয়-মনও জয় করেছেন। মুসা বিন নুসাইর আন্দালুসিয়ার যেসকল নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গকে সাথে করে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তাদের মধ্যে গোথ সম্প্রদায়ের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ যেমন ছিলেন খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গও ছিলেন। তিনি কয়েকজন ইহুদি সরদারকেও এই কাফেলায় অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।