‘এখানকার অধিবাসীরা মুসলমান নয়। এজেলুনা বলল। এরা তোমাকে, তোমার বাবাকে, আর সিপাহসালার তারিক বিন যিয়াদকে বাদশাহ মনে করে। এখানকার লোকজন রাজা-বাদশাহকে সম্মান করতে অভ্যস্ত। যদি তোমরা তাদেরকে এই কথা চিন্তা করার সুযোগ করে দাও যে, তোমরাও তাদের মতো সাধারণ মানুষ তাহলে তাদের উপর তোমাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বহাল রাখতে পারবে না। তারা তোমাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসবে। তোমার সম্মানিত পিতা একজন সাধারণ প্রজার মতো আসবেন, আর প্রজা সাধারণ তাঁর প্রতি কোন সম্মান প্রদর্শন করবে না–এই অপমান আমি মেনে নিতে পারব না। এর যাবতীয় ব্যবস্থা আমি নিজেই করব।’
ইতিহাসবিদগণ লেখেছেন, এজেলুনা এক মোহনীয় জাদু হয়ে আবদুল আযীযের উপর প্রভাব বিস্তার করে রেখেছিল। একদিকে আবদুল আযীয ছিলেন স্ত্রীর অতিশয় বাধ্যগত স্ত্রৈণ এক স্বামী। অপরদিকে দুর্দান্ত এক সিপাহসালার, আর বিচক্ষণ প্রশাসক।
এজেলুনা শুরু থেকে রাজরানী হতে চাচ্ছিল। মুসা বিন নুসাইরের আগমনের কথা শুনে সে শহরময় ঘোষণা করিয়ে দিল যে, কয়েকদিনের মধ্যেই মিসর, আফ্রিকা ও আন্দালুসিয়ার সম্মানিত আমীরের শুভাগমন হবে। যখনই ঘোষণা করা হবে, তিনি আগমন করছেন, তখন শহরের সকল নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ-শিশু শহর থেকে বের হয়ে সম্মানিত আমীরকে খোশআমদেদ জানাবে।
এজেলুনা মুসা বিন নুসাইরকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য জমকালো আয়োজনের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এ উপলক্ষে সে এ্যাশবেলিয়ার সকল প্রশাসকের কাছে বিভিন্ন নির্দেশনামূলক বার্তা পাঠাতে লাগল। এই বিশাল আয়োজনের অংশ হিসেবে দু’জন ঘোড়সওয়ারকে টলেডুর উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেওয়া হল। তাদের দায়িত্ব হল, মুসা বিন নুসাইরের কাফেলা টলেডুর সীমানা অতিক্রম করার সাথে সাথে তারা ঘোড়া ছুটিয়ে এসে এজেলুনাকে সংবাদ দেবে।
অবশেষে মুসা বিন নুসাইরের আগমনের দিন সমাগত হল। সে দিন দ্বীপ্রহরের সময় ঘোড়সওয়ার দু’জন দ্রুত গতিতে ঘোড়া ছুটিয়ে শহরে এসে প্রবেশ করল। তারা সরাসরি আবদুল আযীযের সামনে এসে বলল, শীঘ্রই আফ্রিকা ও আন্দালুসিয়ার সম্মানিত আমীরের আগমন ঘটছে। তারা যে দূরত্বের কথা বলল, তা বেশি হলে এক ঘণ্টার পথ হবে।
সংবাদ পেয়ে এজেলুনা ব্যস্ত হয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এলো। সে আস্তাবল থেকে ঘোড়া আনানোর পরিবর্তে আগত ঘোড়সওয়ারদের একজনের ঘোড়ায় চড়ে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। কার কাছে যেতে হবে, কার উপর কোন দায়িত্ব থাকবে–এ জাতীয় সকল বন্দোবস্ত এজেলুনা পূর্বেই করে রেখেছিল।
***
এ্যাশবেলিয়ার দিকে বিশাল এক বাহিনী এগিয়ে আসছে। কাফেলার সামনের সারিতে আছেন মুসা বিন নুসাইর, তারিক বিন যিয়াদ, আর মুগীস আর-রুমীসহ অন্যরা। তাদের পিছনে দুই থেকে আড়াইশ সৈন্যের রক্ষীবাহিনী। তাদের পিছনে কয়েক হাজার যুদ্ধবন্দী। বন্দীদের হাত রশি দিয়ে বাঁধা। বন্দীদের মাঝে আছে রডারিকের সৈন্যবাহিনীর উচ্চপদস্ত কর্মকর্তা আর সাধারণ সিপাহী। অনুগ্রহ করে উচ্চপদস্ত কর্মকর্তাদেরকে ঘোড়র উপর সওয়ার হওয়ার অনুমতি প্রদান করা হয়েছে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বন্দী হল কর্ডোভার গভর্নর। মুগীস আর-রুমী তাকে বন্দী করেছিলেন। বন্দীদের পিছনে ঘোড়াগাড়ির বিশাল বহর। ঘোড়াগাড়িগুলো দাসী-বান্দিতে ঠাসা। এদের পিছনে অসংখ্য খচ্চর আর খচ্চরচালিত টাঙাগাড়ি। এগুলোর উপর বিপুল পরিমাণ গনিমতের মাল বোঝায় করা।
শহর থেকে দেড় মাইল দূরে কাফেলা পৌঁছলে দেখা গেল, শহরের অধিবাসীরা রাস্তার দুপাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। সাধারণ মানুষের সামনে মুসলিম সিপাহীরা বর্শা হাতে নিয়ে দাঁড়ানো। প্রতিটি বর্শার অগ্রভাগে ত্রিকোণবিশিষ্ট সবুজ ঝাণ্ডা বাঁধা। প্রত্যেক সিপাহী তার বর্শার নিম্নাংশ মাটির সাথে লাগিয়ে উপরের অংশ সামনের দিকে সামান্য ঠেলে দিয়ে ধরে আছে। বহুদূর পর্যন্ত সবুজ ঝাণ্ডার আশ্চর্য রকম সুন্দর এক দৃশ্য দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল। সেই সাথে সৈন্যদের অভিন্ন সফেদ পোশাক সৌন্দর্যের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। পদাতিক সৈন্যদের সারি যেখানে এসে শেষ হয়েছে সেখান থেকে অশ্বারোহী সৈন্যদের সারি শুরু হয়েছে। শিশু ও নারীদেরকে সকলের সামনে দাঁড় করানো হয়েছে। তারা সকলেই হাত নেড়ে নেড়ে কাফেলাকে স্বাগতম জানাচ্ছে, আর সমস্বরে চিৎকার করে বলছে, মুসা বিন নুসাইর খোশ আমদেদ! মুসা বিন নুসাইর জিন্দাবাদ! যুবতী মেয়েরা ফুলের ডুলি হাতে নিয়ে মুসা বিন নুসাইরকে লক্ষ্য করে ফুলের পাপড়ী ছুঁড়ে মারছে।
এই দৃশ্য দেখে মুসা বিন নুসাইরের ঠোঁটের কোণে ভিন্ন রকম মুচকি হাসির আভা ঝিলিক দিয়ে উঠল। দম্ভ আর ঔদ্ধত্বের কারণে তার গর্দান ঈষৎ বেঁকে ছিল। প্রফেসর ডোজি, ডানপাল, ইবনে বাশকুল ও ড. কুন্ডে প্রমুখ ইতিহাসবিদগণ আরও কয়েকজন ইতিহাসবিদের বরাত দিয়ে উল্লেখ করেছেন, মুসলিম বিজেতাগণ এ জাতীয় রাজকীয় শান-শওকাত ও জমকালো অভ্যর্থনার, পক্ষপাতি ছিলেন না। ইসলামে এ জাতীয় রাজকীয় মহড়া প্রদানের কোন সুযোগ নেই। উচিত ছিল মুসা বিন নুসাইর এই রাজকীয় জমকালো অভ্যর্থনাকে অপছন্দ করে জিজ্ঞেস করবেন, কে এই অনৈসলামিক প্রথার আয়োজন করেছে? তাঁর উচিত ছিল এ জাতীয় মহড়া প্রদর্শনকারীকে জনসম্মুখে ডেকে এনে তিরস্কার করা। আশ্চর্য হলেও সত্য যে, তিনি এই রাজকীয় অভ্যর্থনায় আনন্দিত হন। তার মুচকি হাসি, আর চেহারার অভিব্যক্তি থেকে সুস্পষ্টরূপে বুঝা যাচ্ছিল, তিনি অত্যন্ত খুশী হয়েছেন। তবে তারিক বিন যিয়াদ, মুগীস আর-রুমীসহ অন্যান্য সালারদের চেহারার অভিব্যক্তিতে বিরক্তির চিহ্ন পরিলক্ষিত হচ্ছিল।