মুসা বিন নুসাইর হাসি ধরে রাখতে পারলেন না। তিনি হাসতে হাসতে বললেন। মুসলমান তার সৃষ্টিকর্তার উপর বিশ্বাস রাখে। আল্লাহর ইচ্ছা সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। কোন মুসলমান যদি কোন মানুষের ভবিষ্যদ্বাণী সত্য মনে করে তাহলে সে মুশরিক হয়ে যায়।’
‘আমি কোন ধর্মের কথা বলছি না।’ মেরিনা বলল। আমি হয়তো আমার ধর্ম সম্পর্কেও কিছু জানি না। আমি এও জানি না যে, আমি কীভাবে বুঝতে পারলাম, আপনার এই সফর শুভ হবে না। আমি দেখতে পাচ্ছি, আপনার আশে-পাশে মৃত্যু ঘুরাফেরা করছে।’
‘তুমি কি কোন পণ্ডিতের কাছ থেকে এই বিদ্যা অর্জন করেছ?’ মুসা বিন নুসাইর জানতে চাইলেন।
‘না।’ মেরিনা বলল। আমার ভিতর থেকে, আমার নিজের অস্তিত্ব থেকে আমি একটি আলো অনুভব করি। আমি আপনাকে কোন ধোঁয়াশার মধ্যে রাখতে চাই না। আমি আপনাকে বলতে চাই, আমি কী ছিলাম, কী হয়েছি?’
‘তোমার সম্পর্কে আউস আমাকে সবকিছুই বলেছে।’ মুসা বিন নুসাইর বললেন। তোমার প্রতি যে অবিচার করা হয়েছে, তা আমি জানি। তোমার অনাকাক্ষিত দুঃখ-কষ্টের জন্য আমরা সকলেই সমবেদনা প্রকাশ করছি। বরং তুমি এখন কোথায় গিয়ে পৌঁছেছ, সে কথায় বল।’
পৃথিবীর এক অন্ধকার জগতে আমার বসবাস ছিল। মেরিনা বলতে লাগল। আমি নির্যাতিত ছিলাম বটে, তবে আমি নিজেকে গুনাহগার মনে করি। আমি রডারিকের রক্ষিতা ছিলাম। রডারিককে আমার হাতের মুঠোয় নেওয়ার জন্য আমি অনেক ধোঁকা, আর ছলনার আশ্রয় নিয়েছিলাম। নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য আমি অনেকের সাথে প্রতারণা করেছি। আত্মপ্রবঞ্চনার মাঝে আমার যৌবন অতিবাহিত হয়েছে। তার পর আমি এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছি। সে আমার সম্প্রদায়ের জাদুকর ছিল। আমি তাকে হত্যা না করলে একজন বেগুনাহ মেয়েকে তার হাতে জীবন দিতে হত। সে রডারিকের বিজয়ের জন্য ঐ মেয়েকে বলি দিতে চাচ্ছিল।
‘আমি এ সবকিছুই জানি।’ মুসা বিন নুসাইর বললেন। আমরা তোমার এই সাহসিকতার প্রশংসা করি। আমরা এর প্রতিদান দিতে চাই।’
‘না, জনাব! মেরিনা বলল। আমি আপনাদের প্রতি কোন রকম অনুগ্রহ করিনি। অনুগ্রহ করে থাকলে নিজের প্রতি করেছি। আমি রডারিক থেকে প্রতিশোধ নিয়েছি। এখন আমার অন্তরে কোন উপহার-উপঢৌকনের লোভ নেই। আমি আমার অন্তরাত্মাকে গুনাহের পঙ্কিলতা থেকে পবিত্র করছি। এখন সমগ্র আন্দালুসিয়ার বাদশাহীও যদি আমার পদতলে রেখে দেওয়া হয় তাহলেও আমি সেই নির্জন ছোট্ট উপাসনালয় থেকে বের হবে না, যেখানে আমি নিজেকে বন্দী করে রেখেছি। আমার অন্তরাত্মা পবিত্র হয়ে গেছে। আমি যেখানে থাকি সেখানে রূহানী জগতের আত্মারাও এসে থাকে। সম্ভবত তারাই আমাকে ভবিষ্যতের সংবাদ দিয়ে যায়।’
মুসা বিন নুসাইরের ঠোঁটের উপর মুচকি হাসির রেখা ফুটে উঠল। তিনি অন্যান্য সালারদের লক্ষ্য করে বললেন, এই মেয়ের মস্তিষ্ক ঠিক নেই।’
‘আমি আপনাকে আরেকটি বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে দিচ্ছি।’ মেরিনা বলল। ‘আমার প্রতি দয়ার্দ হয়ে আমাকে সেই প্রাচীন উপাসনালয় থেকে উঠিয়ে এই মহলে এনে আরাম-আয়েশে রাখবেন–এমনটি চিন্তাও করবেন না। আউপাস আমাকে ভালোবেসে ছিল। পরিণতিতে তার খান্দানের বাদশাহী রক্তের দরিয়ায় ভেসে গেছে। তার ভাই যিনি বাদশাহ ছিলেন, মারা গেছেন। রডারিক আমাকে তার মহলে নিয়ে গিয়েছিল। সে আমাকে তার কামনা-বাসনার পুতুল বানিয়ে রেখেছিল। তার বাদশাহীর নাম-নিশানাও আজ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। সেও বেঘোরে মারা গেছে। আমি আপনার মহলে কিছুতেই থাকব না।’
মেরিনা কিছুক্ষণ নীরব থেকে পুনরায় বলতে শুরু করল।
‘আমি আপনাকে আবারও বলছি, এই সফরের চিন্তা মন থেকে বের করে দিন।’ এ কথা বলে মেরিনা একেবারে চুপ হয়ে গেল। গোটা দরবারে পীনপতন নীরবতা ছেয়ে গেল। মেরিনা ধীরে ধীরে বসা থেকে উঠে গাম্ভির্যের সাথে পা ফেলে দরজা পর্যন্ত এসে দাঁড়াল। তারপর পেছন ফিরে বলল :
মুসলমানদের আমীর, আন্দালুসিয়া হল প্রেতাত্মাদের দেশ। এখানে আবহমান কাল থেকে মানুষের রক্ত ঝরেছে। ভবিষ্যতেও রক্ত ঝরবে। এখানের মাটিতে অত্যন্ত ভয়ঙ্কর ও রহস্যময় ভেদ লুকানো আছে। এখানের আকাশে-বাতাসে রহস্যের ছড়াছড়ি।
এ কথা বলে মেরিনা দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল।
‘এই মেয়েটির প্রতি আমার আন্তরিক সহানুভূতি আছে। মুসা বিন নুসাইর বললেন। দ্রুত সফরের প্রস্তুতি গ্রহণ কর। টলেডুর পরিবর্তে এ্যাশবেলিয়াই হবে আন্দালুসিয়ার রাজধানী। দু-এক দিনের মধ্যেই আমরা এ্যাশবেলিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হব।’
***
দুদিন পর বিশাল বড় এক বাহিনী নিয়ে মুসা বিন নুসাইর এ্যাশবেলিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। আবদুল আযীয এ্যাশবেলিয়াতেই ছিলেন। পূর্বেই তাঁকে জানানো হয়েছিল যে, মুসা বিন নুসাইর আর তারিক বিন যিয়াদ এ্যাশবেলিয়া আসছেন। সংবাদ শুনে আবদুল আযীযের স্ত্রী এজেলুনা তৎপর হয়ে উঠল।
‘গোটা শহর সম্মানিত আমীরকে সংবর্ধনা জানাবে।’ এজেলুনা আবদুল আযীকে বলল। শহরের অধিবাসীগণ শহর থেকে বের হয়ে পথের দুই পাশে দাঁড়িয়ে আমীর মুসাকে খোশআমদের জানাবে।
‘না, এজেলুনা!’ আবদুল আযীয বললেন। আমীর মুসা এমনটি পছন্দ করবেন না। আমাদের ধর্ম লোকজনকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রেখে এমন রাজকীয় অভ্যর্থনা প্রদানের অনুমতি দেয় না। এটা অহংকার আর অহমিকা ছাড়া আর কিছুই নয়। এটা ফেরাউনদের কর্মপন্থা।