টলেডু এসে মুসা বিন নুসাইর খলীফার জন্য বরাদ্ধকৃত হাদিয়া আর বায়তুল মালের গনিমত পৃথক করা শুরু করেন। যুদ্ধবন্দীর সংখ্যাই ছিল কয়েক হাজার। সেসকল বন্দীদের খোঁজ-খবর নেওয়া এবং তাদের মধ্য থেকে যাদেরকে দামেস্ক নিয়ে যাবেন, তাদেরকে নির্বাচন করাও অত্যন্ত জরুরী একটি বিষয় ছিল।
জুলিয়ান ও আউপাস মুসা বিন নুসাইরের সাথেই ছিলেন। আউপাস মেরিনাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। তারিক বিন যিয়াদ যখন টলেডু জয় করেন তখন একদিন মেরিনা এক ইহুদি জাদুকরের লাশ হাদিয়াস্বরূপ তারিক বিন যিয়াদের সামনে পেশ করে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। সেদিনের পর থেকে আউপাস মেরিনাকে অনেক জায়গায় তালাশ করেছে, কিন্তু কোথাও তাকে খুঁজে পায়নি। এবার মুসা বিন নুসাইরের সাথে টলেডু আসার পরও আইপাস মেরিনার খোঁজ-খবর নিতে লাগল। অনেক খোঁজাখুজির পর মেরিনার সন্ধান পাওয়া গেল। আউপাস একদিন মেরিনার কাছে গিয়ে উপস্থিত হল।
মেরিনা হল টলেডুর অধিবাসী। সে নিজ গৃহে বাবা-মার কাছে না গিয়ে ছোট্ট একটি উপাসনালয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। এই উপাসনালয়টি ছিল অত্যন্ত প্রাচীন আর লোকালয় থেকে অনেক দূরে। লোকজনের আনাগুনা এখানে ছিল না বললেই চলে। মেরিনা এই নির্জন উপাসনালয় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে সেখানে আস্তানা গেড়ে বসে। সে সবসময় সাদা কাপড়ে নিজেকে আবৃত করে রাখত। কাপড় দিয়ে এমনভাবে মাথা পেঁচিয়ে রাখত যে, বাইরে থেকে একটি চুলও দেখা যেত না।
বহুদিন পর আউপাসকে দেখতে পেয়ে মেরিনার চোখে-মুখে কোন রকম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হল না। মেরিনা সবরকম ক্রিয়া-প্রক্রিয়ার উর্ধ্বে চলে গিয়েছিল।
‘এখানে কী করছ, মেরিনা!?’ আটপস আবেগতাড়িত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল।
‘তপস্যা করছি।’ মেরিনা আত্মনিমগ্ন ভঙ্গিতে ভাবাবেগহীন কণ্ঠে উত্তর দিল। ‘খোদাওন্দের নিকট আপন গুনাহের জন্য ক্ষমা ভিক্ষা করছি। তুমি কেন এসেছ?’
‘মেরিনা, আমি তোমাকে সাথে করে নিয়ে যেতে এসেছি। আউস বলল। ‘এটা তোমার উপযুক্ত স্থান নয়। তুমি শাহীমহলের গুরুত্বপূর্ণ একজন সদস্য।
‘শাহীমহল! মেরিনা তাচ্ছিল্যের সাথে বলে উঠল। সেই শাহীমহল, যেখানে আমার আশা-আকাক্ষা, প্রেম-ভালোবাসা, স্বপ্ন-সাধনার সমাধি রচিত হয়েছে?
এখন আর সেই মহলে রডারিক নেই। আউপাস বলল। রডারিকের বংশের কেউই আজ সেখানে থাকে না। সেই মহল এখন মুসলমানদের দখলে। সেখানে পাপাচারের কোন নাম-নিশানাও নেই। সেখানে কেউ মদ্য পান করে না। কেউ কোন নারীর উপর নির্যাতন করে না। সেই মহল এখন পবিত্র হয়ে গেছে।
‘আউপাস, আমি এখনও পবিত্র হয়নি। মেরিনা বলল। যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন আমি আমার আত্মার পরিশুদ্ধির জন্য চেষ্টা করে যাব।’
‘আমি তোমাকে মুসলমানদের আমীরের নিকট নিয়ে যেতে চাই।’ আউপাস বলল। আমি তাকে বলতে চাই, এই সেই নারী, যে আড়ালে থেকে গোয়াডিলেট নদীর তীরে সংঘটিত যুদ্ধে রডারিককে পরাজিত করেছিল।’
‘এ কথা শুনে মুসলমানদের আমীর আমাকে পুরস্কৃত করবেন, তাই না? মেরিনা বলল। আউপাস, এ কথাই তো তুমি আমাকে বলতে চাচ্ছ? দুঃখিত, আউপাস! আমি উপহার-উপঢৌকনের দুনিয়া থেকে বের হয়ে অনেক দূর চলে এসেছি।’
‘আমীর মুসা তোমাকে দেখতে চান, মেরিনা!’ আটপাস বলল। তোমার মনে কি আমার জন্য সামান্য ভালোবাসাও অবশিষ্ট নেই? আমি তোমাকে আমার ভালোবাসার দোহায় দিয়ে বলছি, আমার সাথে চল, পরে না হয় ফিরে আসবে…। আমীর মুসা দামেস্ক চলে যাচ্ছেন।
ভালোবাসার দোহায় দেওয়াতে মেরিনা আউপাসের সাথে যেতে রাজি হল।
ইউরোপিয়ান ইতিহাসবিদ গোয়ানগোজ লেখেন, মেরিনার ব্যক্তিত্বের মাঝে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল। সে সত্যিকার অর্থেই দুনিয়াবিমুখ হয়ে গিয়েছিল। তার মাঝে এক অপার্থিব আধ্যাত্মিক শক্তির উন্মেষ ঘটেছিল।
***
রডারিককে পরাজিত করার পিছনে মেরিনার যে বিশাল ভূমিকা ছিল সে ব্যাপারে তারিক বিন যিয়াদ, জুলিয়ান ও আউপাস সকলেই মুসা বিন নুসাইরকে অবহিত করেছিলেন। সেই দুর্দান্ত সাহসী মেয়ে মেরিনা এখন মুসা বিন নুসাইরের সামনে দাঁড়ানো। মুসা বিন নুসাইর আশ্চর্য হয়ে মেরিনাকে দেখছেন। মেরিনাও গভীর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল।
‘বস, মেয়ে। মুসা বিন নুসাইর মেরিনাকে লক্ষ্য করে বললেন। আমাদের কাছে তোমার গুরুত্ব অনেক বেশি। আমরা অবশ্যই তোমাকে তোমার কাজের প্রতিদান প্রদান করব।’
আউপাস মেরিনাকে মুসা বিন নুসাইরের কথা তরজমা করে শুনাচ্ছিল। কিন্তু মেরিনার চোখে-মুখে এমন একটা প্রতিক্রিয়া ধীরে ধীরে ফুটে উঠছিল যেন, সে কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। তার দৃষ্টি মুসা বিন নুসাইরের চেহারার উপর আটকে আছে।
‘তোমার আমীরকে বল, তিনি যেন স্বদেশে ফিরে না যান।’ মেরিনা আতঙ্কিত কণ্ঠে বলে উঠল। এই সফর তাঁর জন্য কল্যাণকর হবে না।’
‘আমি আমার দেশে গেলে কী ক্ষতির সম্মুখীন হব?’ মুসা বিন নুসাইর মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলেন।
‘এই সফর আপনার জন্য শুভ হবে না।’ মেরিনা দৃঢ়কণ্ঠে বলল। এই সফর আপনার জন্য লাঞ্ছনা আর অপমানের কারণ হবে। আরও খারাপ কিছুও হতে পারে।’
কথা বলতে বলতে মেরিনার আওয়াজ উঁচু হতে লাগল। তার কণ্ঠ থেকে ভীতি ছড়িয়ে পড়ল। সে বলতে লাগল, যাবেন না, আমীর! … আপনি যাবেন না…। পরিণতি ভাল মনে হচ্ছে না …। আপনার চোখ বলছে, এই চোখে পুনরায় আন্দালুসিয়া দেখা সম্ভব হবে না।’