নওয়াব যুলকদর জংবাহাদুর স্বীয় গ্রন্থ ‘খেলাফতে উন্দুলুস’-এ একাধিক অমুসলিম ইতিহাসবিদের বরাত দিয়ে একটি ঘটনা লেখেছেন। এই ঘটনা থেকেও আরবদের বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায়।
ঘটনাটি এ্যাশবেলিয়া অবরোধের সময়কার। (পূর্বে এ্যাশবেলিয়া অবরোধের বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হয়েছে।) এ্যাশবেলিয়ার বাহিনী জীবনবাজি রেখে মুসলিম বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করছিল। কিন্তু মুসলিম বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের সামনে ঠিকতে না পেরে তারা সন্ধির প্রস্তাব দিতে বাধ্য হয়।
অন্য আরেকটি বিবরণে পাওয়া যায় যে, মুসলিম বাহিনী এ্যাশবেলিয়ার শহররক্ষা প্রাচীরের একটি অংশ ভাঙ্গতে সক্ষম হয়। সেই ভাঙ্গা দেয়াল দিয়ে একদল মুসলিম সৈন্য ভিতরে চলে আসে। এদের সকলেই ছিলেন আরব। খ্রিস্টান সৈন্যরা এই আরব সৈন্যদের উপর এমন প্রচণ্ড আক্রমণ করে যে, সকল অরিব সৈন্যই শহীদ হয়ে যান। পরবর্তীতে এখানে এসকল শহীদগণের স্মৃতির উদ্দেশ্যে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। এটি শহীদি স্মৃতিসৌধ নামে আজও বিদ্যমান আছে।
বিপুল সংখ্যক মুসলিম সৈন্যের জীবনহানির কারণে মুসা বিন নুসাইর হতাশ হয়ে সন্ধির প্রস্তাব পেশ করেন। শহরের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ মুসা বিন নুসাইরের নিকট আসেন। মুসা বিন নুসাইর মুসলিম বাহিনীর পক্ষে বিভিন্ন শর্ত আরোপ করেন। এ্যাশবেলিয়ার ব্যক্তিবর্গ শর্ত কবুল করতে অসম্মতি জানালে দুদিন পর পুনরায় আলোচনার দিন ধার্য হয়।
মুসা বিন নুসাইরের দাড়ি ও মাথার চুল ছিল সম্পূর্ণ সাদা। সেসময় পর্যন্ত কেবলমাত্র মুসলমানগণই খেজাব সম্পর্কে অবগত ছিলেন। মূলত মুসলমানরাই খেজাব আবিষ্কার করেছিলেন। আন্দালুসিয়ার অধিবাসীরা খেজাব সম্পর্কে অবগত ছিল না।
এ্যাশবেলিয়ার প্রতিনিধি দল দ্বিতীয়বার সন্ধির শর্ত নিয়ে আলোচনা করার জন্য আসেন। মুসা বিন নুসাইর তখন তাঁর দাড়ি ও চুলে লাল রংগের খেজাব লাগিয়ে রেখেছিলেন। প্রতিনিধি দলের সদস্যরা মুসা বিন নুসাইরকে অবাক হয়ে দেখছিলেন। তারা ভাবছিলেন, সাদা চুল লাল হয়ে গেল কীভাবে? সন্ধির শর্ত নিয়ে আলোচনা শুরু হল। কিন্তু দ্বিতীয়বারের আলোচনাও ফলপ্রসূ হল না। কারণ, মুসা বিন নুসাইরের পক্ষ থেকে অনেক কঠিন শর্ত আরোপ করা হচ্ছিল। তিনি তাদেরকে অস্ত্র সমর্পণের জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। দুদিন পর আবারও আলোচনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হল।
দুদিন পর উভয় পক্ষ তৃতীয়বারের মতো আলোচনায় বসলেন। এবার এ্যাশবেলিয়ার প্রতিনিধি দল এসে দেখল যে, মুসা বিন নুসাইরের লাল দাড়ি ও চুল কালো হয়ে গেছে। তিনি কালো খেজাব ব্যবহার করেছিলেন। তাঁর বয়স হয়েছিল প্রায় আশি বছর। হাটার সময় তাঁর মাথা সামান্য ঝুঁকে পড়ত। কিন্তু মুসা বিন নুসাইর নওজোয়ানের মতো সিনা টান করে মাথা উঁচিয়ে হাটছিলেন। আজকের আলোচনাও ভেস্তে গেল।
মুসা বিন নুসাইর অত্যন্ত কঠোর ভাষায় প্রতিনিধি দলকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘আর কোন আলোচনা নয়, তোমাদের সাথে আমাদের পরবর্তী সাক্ষাত হবে তোমাদের শহরে। তোমাদের সৈন্যদের লাশ মাড়িয়ে আমাদের সৈন্য শহরে প্রবেশ করবে। তখন আমার তলোয়ারই তোমাদের শর্ত নির্ধারণ করবে।
নওয়াব যুলকদর জংবাহাদুর লেখেছেন :
এ্যাশবেলিয়ার প্রতিনিধি দল দুর্গে ফিরে এসে নিজেদের মধ্যে শলা-পরামর্শ করতে বসল।
‘ওদের শর্ত মেনে নাও।’ প্রতিনিধি দলের একজন নেতা বলল। ঐ সিপাহসালার কোন অলৌকিক শক্তির অধিকারী হবেন। তোমরা নিশ্চয় দেখেছ, তিনি কতটা বয়োবৃদ্ধ ছিলেন। তাঁর একটি চুল-দাড়িও কালো ছিল না। আমরা দেখলাম, তাঁর সাদা-শুভ্র চুল-দাড়ি প্রথমে লাল হয়ে গেল। তারপর লাল চুল-দাড়ি কালো হয়ে গেল। এখন তিনি নওজোয়ানদের মতো কথা বলছেন, চলাফেরা করছেন। তাছাড়া এই মুসলিম বাহিনী দেখতে দেখতে গোটা রাজ্যের উপর ঝেকে বসেছে।’
প্রতিনিধি দলের পারস্পরিক আলোচনার ফলাফল এই দাঁড়াল যে, তারা সকলেই মুসা বিন নুসাইরের যাবতীয় শর্ত মেনে নিল।
***
উপরের ঘটনা থেকে মুসা বিন নুসাইরের বুদ্ধিমত্তা আর বিচক্ষণতার পরিচয় পাওয়া যায়। মুসা বিন নুসাইর তার অসাধারণ ধীশক্তি আর দূরদৃষ্টির মাধ্যমে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, খলীফার নির্দেশ মেনে নেওয়া উচিত। যারপরনাই তিনি আর তারিক বিন যিয়াদ দামেস্কের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে টলেডু এসে পৌঁছেন। সালার মুগীস আর-রুমিও তাঁদের সাথে দামেস্ক যেতে চান। মুসা বিন নুসাইর তাকে দামেস্ক নিতে চাচ্ছিলেন না।
‘সম্মানিত আমীর! মুগীস আর-রুমি বললেন। আমি কর্ডোভা জয় করেছি। কর্ডোভার গভর্নর হাতিয়ার সমর্পণ করতে অস্বীকার করেছিল। সে যুদ্ধে আমাদেরকে অনেক বেশি জানের নাযরানা পেশ করতে হয়েছিল। অবশেষে জীবনবাজি রেখে আমি গভর্নরকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছিলাম। আপনি আমিরুল মুমিনীনের জন্য উপহারস্বরূপ ত্রিশ হাজার যুদ্ধবন্দী ও অসংখ্য দাস-দাসী নিয়ে যাচ্ছেন। আমি শুধু এই একজন যুদ্ধবন্দীকে আমিরুল মুমিনীনের কাছে পেশ করতে চাই–এই অধিকার কি আমার নেই।
‘অবশ্যই তোমার এই অধিকার আছে।’ মুসা বিন নুসাইর তার আবেদন মঞ্জুর করে তাকে দামেস্ক যাওয়ার অনুমতি প্রদান করেন।
মুসা বিন নুসাইর কয়েক দিন টলে অবস্থান করতে চাচ্ছিলেন। তিনি দ্রুতগতির এক ঘোড়সওয়ারকে এই বার্তাসহ দামেস্ক পাঠিয়ে দিলেন যে, মুসা বিন নুসাইর আর তারিক বিন যিয়াদ দামেস্কের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেছেন, তাঁরা অতিসত্তর দামেস্ক এসে পৌঁছবেন।