‘আমীরুল মুমিনীন কি জানেন, আমি আর তারিক বিন যিয়াদ যদি এখান থেকে চলে যাই তাহলে বিজিত আন্দালুস আমাদের হাত ছাড়া হয়ে যাবে? মুসা বিন নুসাইর আবু নসরকে লক্ষ্য করে বললেন।
‘আমিরুল মুমিনীন কী জানেন, আর কী জানেন না–এটা আমার জানার বিষয় নয়। আবু নসর বললেন। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন, যদ্রুত সম্ভব মুসা বিন নুসাইর আর তারিক বিন যিয়াদ যেন দামেস্ক চলে আসে।’
কোন কোন ঐতিহাসিক লেখেছেন, খলীফা ওলিদ বিন আব্দুল মালেক পূর্বেও মুসা বিন নুসাইরকে দামেস্ক ডেকে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি অভিযান পরিচালনায় আর নতুন নতুন শহর জয়ের নেশায় এতটাই বিভোর হয়ে গিয়েছিলেন যে, দামেস্কের পয়গাম ভুলেই গিয়েছিলেন। খলীফা ওলিদের সাথে মুসা বিন নুসাইরের সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ। খলীফা অসন্তুষ্ট হতে পারেন এমন কোন আশঙ্কা তার মনে ছিল না। কিন্তু খলীফা তার বিশেষ দূত মারফত এই কঠিন নির্দেশ পাঠান যে, পত্র পাওয়ামাত্রই দামেস্কের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যাবে।
মুসা বিন নুসাইর কালবিলম্ব না করে একজন বার্তাবাহককে এই বলে তারিক বিন যিয়াদের নিকট পাঠিয়ে দিলেন, যতদ্রুত সম্ভব ‘লিউগো চলে এসো। সংবাদ পেয়ে অতিঅল্প সময়ের মধ্যেই তারিক বিন যিয়াদ লিউগো এসে পৌঁছলেন। মুসা বিন নুসাইর তাকে বললেন, আমিরুল মুমিনীনের বার্তাবাহক এসেছেন, আগামী কাল ফজরের নামায পড়েই আমাদের রওনা হতে হবে।’
‘সম্মানিত আমীর!’ তারিক বিন যিয়াদ বললেন। এমন কি হতে পারে না যে, আমিরুল মুমিনীনকে …।
‘ইবনে যিয়াদ!’ আবু নসর তারিক বিন যিয়াদকে থামিয়ে দিয়ে বললেন। ‘আমিরুল মুমিনীন কোন অযুহাত গ্রহণ করবেন না। তাঁর রোষানলের তীব্রতা সম্পর্কে আমি ভালভাবেই অবগত আছি।’
“বেটা তারিক! আমাদেরকে যেতেই হবে। দামেস্ক যাওয়াই আমাদের জন্য মঙ্গলজনক হবে।
মুসা বিন নুসাইরের এই কথাগুলো ইতিহাসের পাতায় সংরক্ষিত হয়ে আছে।
‘আমি কখনই আমার নিজের মঙ্গলের কথা চিন্তা করিনি। তারিক বিন যিয়াদ বললেন। ইসলামী সালতানাতের মঙ্গল কামনাই আমার একমাত্র চিন্তা।
‘বৎস! তুমি আমার হুকুম অমান্য করেছিলে, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি।’ মুসা বিন নুসাইর বললেন। আমিরুল মুমিনীন তার হুকুম অমান্যকারীকে ক্ষমা করবেন না। যাও, প্রিয় বৎস! দামেস্ক যাওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ কর। আমরা আবারও ফিরে আসব। ফ্রান্সের এই সুউচ্চ পর্বতমালা আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে। মুসা বিন নুসাইর আর তারিক বিন যিয়াদ দামেস্ক যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগলেন। তাদের মনে এতটুকু সন্দেহও সৃষ্টি হল না যে, তারা যাচ্ছেন তো ঠিকই; কিন্তু আর কোন দিন এখানে ফিরে আসতে পারবেন না। দামেস্কের কয়েদখানা মুসা বিন নুসাইরের জন্য, আর চিরদিনের ‘গুমনামী তারিক বিন যিয়াদের জন্য অপেক্ষা করছে।
৯. নির্দেশ অমান্য করতে প্রস্তুত
০৯.
তারিক বিন যিয়াদ এক পর্যায়ে আমীরুল মুমিনীনের নির্দেশ অমান্য করতে প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তাঁর আমীর মুসা বিন নুসাইরের অধীন ছিলেন। ইতিপূর্বে তিনি যখন মুসা বিন নুসাইরের নির্দেশ অমান্য করেছিলেন তখন তিনি কারো অধীন ছিলেন না। তাঁর আমীর মুসা বিন নুসাইর তাকে বললেন, আমীরুল মুমিনীনের নির্দেশ এড়িয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। বার্তাবাহক আবু নসরও তাঁকে বলে দিলেন, আমীরুল মুমিনীনের গোসা থেকে বেঁচে থাকাই বুদ্ধিমত্তার কাজ হবে।
মুসা বিন নুসাইরের মনে খলীফার নির্দেশ সম্পর্কে সামান্য সন্দেহ সৃষ্টি হলেও তিনি আবু নসরকে এই বলে ফিরিয়ে দিতেন যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে তার পক্ষে দামেস্ক যাওয়া কোনভাবেই সম্ভব নয়। আন্দালুসিয়া তার হাতের মুঠোয়, আর ফ্রান্স তার পদতলে–এই অবস্থায় দামেস্ক গেলে সদ্য বিজিত আন্দালুসিয়া হাত ছাড়া হয়ে যাবে। কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে মুসা বিন নুসাইর দামেস্ক যাওয়াই সমীচীন মনে করলেন।
প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ গিবনের রচনা থেকে জানা যায়, মুসা বিন নুসাইরের নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী পাইরেন্স থেকে সামনে অগ্রসর হয়ে ফ্রান্সের মধ্যভাগ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। সেসময় ফ্রান্সের বাদশাহ ছিলেন চার্লস মারটিল। মুসলিম বাহিনীর চেয়ে তার সৈন্যসংখ্যা ছিল অনেক বেশি। তারা ছিল অনেক বেশি সুশৃঙ্খল আর আধুনিক অস্ত্রসস্ত্রে সুসজ্জিত।
চার্লসের সাথে মুসলিম বাহিনীর যে যুদ্ধ সংঘটিত হয় মি. গিবন তার কোন বিবরণ দেননি। তিনি এতটুকুই লেখেছেন যে, চার্লস মারটিল ফ্রান্সের মধ্যাঞ্চলের কোন এক এলাকায় মুসলিম বাহিনীকে পরাজিত করে। তখন মুসলিম সেনাপতি মুসা বিন নুসাইর আন্দালুসিয়ার সীমান্ত পর্যন্ত বিজয় অভিযান সীমাবদ্ধ রাখা সমীচীন মনে করেন এবং পিছু হটে আসেন।
মি. গিবন লেখেন, এই সময় তুর্কিরা জামানের উপর আক্রমণ করে বসে। কিন্তু পোল্যন্ডের বাদশাহ সোবসকি তুর্কিদেরকে জার্মানির সীমান্ত এলাকায় রুখে দেয়। মি. গিবন আরও লেখেন, তুর্কি ও আরবদের এই আক্রমণ যদি সফল হয়ে যেত তাহলে ইউরোপের ধর্ম খ্রিস্টবাদের পরিবর্তে ইসলাম হত।
বাস্তব অবস্থা হল এই যে, খলীফা ওলিদ বিন আবদুল মালেক যদি মুসা বিন নুসাইর ও তারিক বিন যিয়াদকে দামেস্ক ডেকে না পাঠাতেন তাহলে এই দুই সিপাহসালার ফ্রান্স জয় করে তবেই ক্ষান্ত হতেন। মুসা বিন নুসাইর যুদ্ধের ময়দানে যেমন অকুতোভয় নির্ভীক সিপাহসালার ছিলেন, তেমনি রণাঙ্গনের বাইরেও ছিলেন অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার অধিকারী।