মুসা বিন নুসাইর আর তারিক বিন যিয়াদের নেতৃত্বে মুজাহিদ বাহিনীর অগ্রযাত্রা এতটাই অবিশ্বাস্য আর অকল্পনীয় ছিল যে, ইউরোপের অতি সাম্প্রদায়িক ইতিহাসবিদগণও বিস্ময়াভিভূত হয়ে মুজাহিদ বাহিনীর বীরত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।
ইতিহাসজগতের নির্ভরযোগ্য ও বিশ্ববিখ্যাত ইতিহাসবিদ মি, গিবন লেখেছেন, মুসলিম জাতি তাদের সংকল্প পুরণে এতটাই আবেগপ্রবণ আর উন্মাদ ছিল যে, হাজার রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর মহাশক্তিধর সুশৃংখল সামরিক-শক্তি তাদের সামনে কোন বাধা হয়ে দাঁড়াতেই পারেনি। তারা আন্দালুসিয়ার সীমান্ত অতিক্রম করে ফ্রান্সের সীমানা পর্যন্ত পৌঁছে তাদের অভিযান মুলতবী করেছে।
‘প্রিয় বৎস! মুসা বিন নুসাইর একদিন তারিক বিন যিয়াদকে লক্ষ্য করে বললেন। আন্দালুসিয়ার কোন শহর, কোন দুর্গ কি এমন আছে, যা আমরা এখনও বিজিত করিনি?’
‘না, সম্মানিত আমীর!’ তারিক বিন যিয়াদ বললেন। আন্দালুসিয়ার এমন কোন শহর, এমন কোন দুর্গ অবশিষ্ট নেই–যেখানে ইসলামের ঝাণ্ডা সগৌরবে মাথা উঁচু করে উড়ছে না।’
‘ইবনে যিয়াদ, আল্লাহর কসম!’ মুসা বিন নুসাইর বললেন। “তুমি নিশ্চয় আমাকে সমর্থন করবে যে, আমাদের উচিত ফ্রান্স আক্রমণ করা।
“ইসলামী সাম্রাজ্যের কোন সীমানা নেই, সম্মানিত আমীর। তারিক বিন যিয়াদ বললেন। আমাদের উচিত ফ্রান্সের শেষ সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া।’
নওয়াব যুলকদর জঙ্গ বাহাদুর স্বীয় গ্রন্থ ‘খেলাফতে আন্দালুস’-এর মাঝে বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের বরাত দিয়ে লেখেছেন, মুসা বিন নুসাইর ফ্রান্সের সীমান্ত এলাকায় কিছু দিন অবস্থান করেন, যেন যুদ্ধক্লান্ত মুজাহিদগণ কিছুটা বিশ্রাম নিতে পারেন এবং আহত মুজাহিদগণ সুস্থ হতে পারেন।
বিশ্রামের এই দিনগুলোতে মুসা বিন নুসাইর আর তারিক বিন যিয়াদ গোটা ইউরোপ জয় করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তার পর একদিন ভোরের আলো ফুটার আগেই মুসলিম বাহিনীকে নিয়ে ফ্রান্সের সীমান্তবর্তী একটি এলাকায় আক্রমণ করে বসেন।
‘খেলাফতে আন্দালুস’-এর মাঝে আরও আছে যে, মুসলিম বাহিনী ফ্রান্সের বড় দুটিই শহর বারসেলুনা, আর নারবুন কোন রকম প্রতিরোধ ছাড়া জয় করে। নেন। নারবুন টলেডু থেকে এক হাজার পঞ্চাশ মাইল দূরে অবস্থিত একটি শহর। সেই তখন থেকে এই শহর দুটি আন্দালুসিয়ার অংশ হয়ে আছে। অনেক ঐতিহাসিকগণই লেখেছেন যে, ফ্রান্সের সৈন্য বাহিনী মুসলিম বাহিনীর সামনে কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল।
আর এমনটা হওয়া খুবই স্বাভাবিক। কারণ ফ্রান্সের বাহিনী আন্দালুসিয়ার বাহিনীর চেয়েও যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল।
সামনেই ছিল ফ্রান্সের দুর্গম পাহাড়ীসারি পাইরেন্স। মুসলমানগণ এর নাম দিয়েছিল জাবাল আল-বারাত। এই পাহাড়গুলোর কোন কোনটির চূড়া ছিল খুবই উঁচু। ঐতিহাসিক গিবন তার প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘রোম সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন’র মাঝে লেখেছেন, মুসা বিন নুসাইর পাইরেন্সের এক সুউচ্চ পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে ফ্রান্সকে তার পদতলে দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আমি আমার বাহিনীতে আরও সৈন্য সমাবেশ করে ইউরোপ জয় করে ‘কনোস্টন্টিনোপল পর্যন্ত পৌঁছব। সেখান থেকে স্বীয় রাজ্য সিরিয়ায় প্রবেশ করব।’
গিবন আরও লেখেন, যদি এই মুসলিম জেনারেল সামনে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ পেতেন তাহলে আজ ইউরোপের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও স্কুলসমূহে বাইবেলের পরিবর্তে কুরআন পড়ানো হত। আল্লাহর একত্ববাদ ও মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নবুওয়াতের পাঠ প্রদান করা হত। ইউরোপে পোপের পরিবর্তে শায়খুল ইসলামের নির্দেশে বিধান কার্যকর হত।
মুসা বিন নুসাইর ফ্রান্সের এই শহর দুটি জয় করে সামনে কেন অগ্রসর হননি–এই প্রশ্নের উত্তর একটি বিবরণ থেকে পাওয়া যায়। বিবরণটি অনেক ঐতিহাসিকের লেখাতেই এসেছে। বিবরণটি হল এই :
মুসা বিন নুসাইর আর তারিক বিন যিয়াদ ফ্রান্সের লিউন শহর বিজিত করে সামনে অগ্রসর হন। পথে তারা বিস্তীর্ণ এলাকা জোড়ে জীর্ণ-শীর্ণ পরিত্যাক্ত কিছু ইমারত দেখতে পান। তারা উভয়ে সৈন্যদের থেকে পৃথক হয়ে ইমারতগুলো পরিদর্শনে বের হন। দেখতে দেখতে তাদের দৃষ্টি একটি স্তম্ভের উপর আটকে যায়। স্তম্ভের উপর খোদাই করে লেখা ছিল–’হে ইসমাইলের বংশধর, এই পর্যন্ত তোমরা পৌঁছে গেছ। এখান থেকেই ফিরে যাও।’
স্তম্ভের অপর দিকে লেখা ছিল–যদি তোমরা এখান থেকে সামনে অগ্রসর হও তাহলে তোমাদের মাঝে বিদ্রোহ দেখা দেবে। এই বিদ্রোহ তোমাদের ঐক্য-সংহতি আর শক্তি বরবাদ করে দেবে।
ঐতিহাসিকগণ লেখেন, দেয়ালের লেখা পড়ে মুসা বিন নুসাইর গভীর চিন্তায় পড়ে যান। তিনি সালারদের সাথে জরুরীভিত্তিতে পরামর্শে বসেন। সালারদের সকলেই তাঁকে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দেন। তারা বলেন, আমরা যে রাজ্য জয় করেছি, সেখানে যথার্থরূপে আইন-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা উচিত। এমন যেন না হয় যে, আন্দালুসিয়ায় আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতি দেখা দেয়। সকলের পরামর্শ অনুযায়ী মুসা বিন নুসাইর ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
ফ্রান্স থেকে ফিরে আসা বা সামনে অভিযান পরিচালনা না করার আরেকটি কারণও পাওয়া যায়। কারণটি হল, মুসা বিন নুসাইর আর তারিক বিন যিয়াদ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে অভিযান পরিচালনা করছিলেন। মুসা বিন নুসাইর ছিলেন ফ্রান্সের ‘লিউগো শহরে, আর তারিক বিন যিয়াদ ছিলেন সেখান থেকে সামান্য দূরে অবস্থিত উরগা শহরে। এমন সময় একদিন দামেস্ক থেকে খলীফার বিশেষ দূত আবু নসর মুসা বিন নুসাইরের নিকট এই পয়গাম নিয়ে হাজির হন যে, পয়গাম পৌঁছা মাত্রই অভিযান মুলতবী করে তিনি এবং তারিক বিন যিয়াদ যেন তৎক্ষণাৎ দামেস্কের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যান এবং পরবর্তী নির্দেশের জন্য দরবারে খেলাফতে হাজির হন।