নদী-নালার সুতীব্র স্রোত বিপদ সীমার উপর দিয়ে বইছিল। পাহাড়ী টিলা আর বড় বড় পাথরের মাঝখান দিয়ে বৃষ্টির পানি বাঁধভাঙ্গা স্রোতের মত ছুটে চলছিল। মুসা বিন নুসাইর, তারিক বিন যিয়াদ, আর অন্যান্য সালারদের অবস্থা ছিল একেবারেই শোচনীয়। কিন্তু তারা কোথাও আশ্রয় তালাশ করছিলেন না। তারা সকলেই পৃথক পৃথকভাবে ঘোড়ায় চড়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়া বাহিনীর সদস্যদের সাথে দেখা-সাক্ষাত করছিলেন। তাদেরকে উজ্জেবিত রাখার জন্য তাদের সাথে হাসি-কৌতুক করছিলেন। তাদের এই হাস্যরস আর কৌতুক শীতে কম্পমান মুজাহিদদের শরীরে উত্তাপ সৃষ্টি করছিল।
প্রচণ্ড ঝঞ্ঝাবায়ু আর বজ্রের বিকট আওয়াজকে উপেক্ষা করে মুসা বিন নুসাইর এক স্থান থেকে আরেক স্থানে ছুটে যাচ্ছিলেন, আর হুঙ্কার ছেড়ে বলছিলেন :
‘উত্তাল সমুদ্র তোমাদেরকে প্রতিহত করতে পারেনি।’
‘আন্দালুসিয়ার স্রোতস্বিনী নদী আর দুর্ল পাহাড় তোমাদেরকে আটকাতে পারেনি।’
‘আন্দালুসিয়ার সুশৃঙ্খল সৈন্যবাহিনী তোমাদেরকে পরাস্ত করতে পারেনি।
‘তোমরা এখানকার পাহাড়সম দুর্গগুলোকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছ।
“এই তুফানও তোমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না।’
প্রত্যেক সালারই মুজাহিদদের হিম্মত বাড়ানোর চেষ্টা করছিলেন। মুসা বিন নুসাইর প্রত্যেক মুজাহিদকে লক্ষ্য করে এ কথাগুলো বারবার বলছিলেন।
‘আমাকে দেখ, আমার বয়সের প্রতি লক্ষ্য কর, এই বয়সে বার্ধক্যের কারণেই শরীর কাঁপতে থাকে। কিন্তু হীম শীতল ঝঞ্ঝাবায়ুর মাঝেও আমি আমার শরীরকে কাঁপতে দিচ্ছি না।’
এসবই ছিল, কথার কথা। বাস্তবতা হল, সকলেই শীতের তীব্রতায় কাঁপছিলেন। কিন্তু কেউই হীনমন্যতা, ভীরুতা আর কাপুরুষতার পরিচয় দিতে প্রস্তুত ছিলেন না। তারা সকলেই তাদের আধ্যাত্মিক শক্তির বলে নিজেদেরকে অটল-অবিচল রেখেছিলেন।
***
সাইক্লোনের তীব্রতা ধীরে ধীরে কমে আসতে লাগল। তুফানী ঝঞ্ঝাবায়ুর প্রচণ্ডতা একসময় শক্তিহীন হয়ে পড়ল। নিশুতি রাতের অন্ধকার দূর হয়ে আস্তে আস্তে ভোরের আলো ফুটে উঠল। সূর্যের আলোতে চতুর্দিক আলোকিত হলে দেখা গেল, গোটা বাহিনীর অবস্থা সেই জাহাজের মত হয়েছে, যা সামুদ্রিক ঝড়ের কবলে পড়ে ডুবো পাহাড়ের সাথে ধাক্কা খেয়ে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেছে। আর জাহাজের টুকরোগুলো ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
মুজাহিদ বাহিনীর কারও পক্ষেই সামনে অগ্রসর হওয়া সম্ভব ছিল না। বেশ কয়েকজন মুজাহিদ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। গোটা বাহিনীকে মাত্র একদিন-একরাতের জন্য বিশ্রামের সুযোগ দেওয়া হল।
পরদিন মুজাহিদ বাহিনী সামনের দিকে চলতে শুরু করল। যেসকল মুজাহিদ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল তাদেরকে ঘোড়ার উপর তুলে নেওয়া হল। ফজরের নামায আদায় করেই মুজাহিদ বাহিনী চলতে শুরু করল। যেখানে তারা নামায আদায় করেছিল, সেখানের মাটি ছিল সঁতসেঁতে। চতুর্দিক থেকে গাছের পাতা বেয়ে বৃষ্টির পানি ঝড়ে পড়ছিল। নামাযের পর মুসা বিন নুসাইর মুজাহিদদের লক্ষ্য করে সংক্ষিপ্ত এক ভাষণ প্রদান করেন। সে ভাষণ আজও ইতিহাসের পাতায় সোনালী হরফে লেখা আছে।
‘আল্লাহ যাদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন তাদেরকে জীবনবিধ্বংসী তুফান থেকে নিরাপদে বের করে নিয়ে আসেন। নূহ আলাইহিসসালামের যুগের সেই প্রলয়ঙ্করী ঝড় থেকে আল্লাহ তাআলা তাদেরকেই বের করে এনেছিলেন, যারা নূহ আলাইহিসসালামের অনুগত ছিল। এতে কোন সন্দেহ নেই, যারা স্বীয় কৃতকর্মের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করবে, আল্লাহ তাআলা তাদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতে পুরস্কৃত করবেন।
তোমরা এই কুফরিস্তানে আল্লাহ ও তার রাসূলের পয়গাম নিয়ে এসেছ। নিঃসন্দেহে তোমাদের পদভার, তোমাদের সেজদার চিহ্ন, আর শহীদদের লাল রক্তের স্পর্শ এই অপবিত্র মাটিকে পবিত্র করে দিয়েছে। আযানের সুমধুর আওয়াজ এখানকার আকাশ-বাতাসকে সুরভিত করে তুলেছে।
নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা ওয়াদা করেছেন, যদি তোমরা ঈমানদার হও এবং সত্যের উপর অটল-অবিচল থাক তাহলে তোমাদের দশজন একশজনের বিপরীতে, আর একশজন এক হাজারের বিপরীতে জয়লাভ করবে। মনে রেখ, তোমরা হলে মুসলমান। তোমাদের মাঝে উঁচু-নীচুর কোন ভেদাভেদ নেই। তোমাদের মধ্যে সেই শ্রেষ্ঠ যে আল্লাহর রাস্তায় জানমাল কুরবানি করার জযবা রাখে। সগ্রামী বন্ধুগণ! আল্লাহ আমাদের সাথেই আছেন।’
মুসা বিন নুসাইরের তেজোদ্দীপ্ত সংক্ষিপ্ত ভাষণের পর গোটা বাহিনী নতুন উদ্যমে দ্বিগুণ উৎসাহে একের পর এক মনযিল অতিক্রম করে আগুনের কেন্দ্রীয় শহর সারগোসা এসে পৌঁছল। সারগোসার আশপাশের এলাকাগুলো ছিল খুবই দৃষ্টিনন্দন। শহরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত মজবুত।
মুসা বিন নুসাইর শহর অবরোধ করার আগে একজন সালারকে এই পয়গাম দিয়ে পাঠালেন যে, দুর্গের লোকদের বল, কোন রকম রক্তপাত ছাড়াই তারা যেন দুর্গের ফটক খুলে দেয়। যদি তারা মোকাবেলা করে, আর আমরা দুর্গ ভেঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করি তাহলে একজনকেও ক্ষমা করা হবে না। আর যদি তারা নিজেরাই দুর্গ খুলে দেয় তাহলে সবধরণের সুযোগ-সুবিধা বহাল থাকবে এবং তাদের সাথে উত্তম আচরণ করা হবে।’
মুসা বিন নুসাইরের নির্দেশ অনুযায়ী সালার সামনে অগ্রসর হয়ে ঘোষণা করলেন।