তারা বড়সড় একটি বাক্স ধরাধরি করে দরবারে প্রশে করল। বাক্সটি মুসা বিন নুসাইরের সামনে রেখে ঢাকনা খালে দিল। তারপর উভয়ে মুসার সামনে দু’জানু হয়ে কুর্নিশ করল। কুর্নিশ শেষে মাথা নিচু করে উল্টো পায়ে বাইরে চলে গেল।
তারা চলে যাওয়ার পর আরো দু’জন হাবশী গোলাম আরেকটি বাক্স নিয়ে দরবারে প্রবেশ করল।
“সিউটার সম্মানিত রাজা! মুসা বিন নুসাইর বলে উঠলেন। আপনার লোকদের বলে দিন, তারা যেন আমাকে কুর্নিশ না করে। আমার সামনে মাথা না ঝুঁকায়।
ইসলামী সালতানাতের আমীর!’ জুলিয়ান বলল। এরা গোলাম, শাহীখান্দানের লোক নয়। এদের কুর্নিশ করতে বাধা দেবেন না।’
‘আমরা সকলেই গোলাম।’ মুসা আসমানের দিকে ইশারা করে বললেন। ‘আমরা কেবল এক বাদশাহকেই কুর্নিশ করি। তাঁর সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে সেজদাবনত হই। সে বাদশাহ হলেন, মহান আল্লাহ। সম্মান প্রদর্শনের এই পদ্ধতি আপনি আপনার দরবারে পালন করুন, আমাদের কোন আপত্তি নেই। এ মুহূর্তে আমরা আল্লাহর দরবারে বসে আছি।’
মুসা বিন নুসাইর জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি কখনও মুসলমানদেরকে একত্রিত হয়ে নামায পড়তে দেখেননি?”
‘আফ্রিকার মহামান্য আমীর! আমি দেখেছি।’ জুলিয়ান বলল। আপনার ফৌজ যখন সিউটা অবরোধ করে তখন এক সন্ধ্যায় আমি দুর্গ প্রাচীরের উপর দাঁড়িয়ে দেখেছি, আপনার ফৌজ একজন ব্যক্তির পিছনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে নামায আদায় করছিল।
‘এ দৃশ্য দেখে আপনার মনে কী অনুভূতি জন্মেছিল? আপনি কি দেখেননি, সেখানে একজন সাধারণ সিপাহী ও সিপাহসালার, সাদা ও কালো, আমীর ও গরীব সকলে এক সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল? সেখানে এমন কোন নিয়ম ছিল না যে, আমীর প্রথম সারিতে দাঁড়াবে, আর গরীব পিছনের সারিতে দাঁড়াবে। ইসলামে গোলাম ও মনিবের মাঝে কোন পার্থক্য নেই। আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে সকলে সমান হয়ে যায়। মানুষের সামনে মানুষের মাথা ঝুঁকিয়ে সেজদা করা হারাম, গুনাহের কাজ।
তিনটি বড় বড় বাক্স দরবারে আনা হল। মুসা বিন নুসাইরের নিষেধসত্ত্বেও বাক্স বয়ে নিয়ে আসা গোলামরা মাথা ঝুঁকিয়ে কুর্নিশ করে যাচ্ছিল, আর জুলিয়ান না বুঝার ভান করে মুচকি-মুচকি হাসছিলেন। তিনটি বাক্সই মহামূল্যবান হাদিয়া-তোহফায় ভরা ছিল। জুলিয়ান এগুলো মুসা বিন নুসাইরের জন্য এনেছিলেন।
‘আফ্রিকার আমীরের জন্য একটি ঘোড়াও এনেছি।’ জুলিয়ান বললেন। বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। আন্দালুসিয়ার জঙ্গী ঘোড়া। এত তীব্র বেগে ছুটে যে, মনে হয়, দৌড়াচ্ছে না; উড়ে চলছে। একমাত্র শাহসওয়ারকেই সে তার পিঠে আরোহণের সুযোগ দেয়। যেখানেই লাগাম টেনে ধরা হয় সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়ে। এই ঘোড়া বেশ কয়েকটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। এটি শাহী আস্তাবলের সেরা ঘোড়া।’
‘আমি নিজের পক্ষ থেকে এবং খলীফাতুল মুসলিমীনের পক্ষ থেকে আপনার শোকরিয়া আদায় করছি।’ মুসা বিন নুসাই বললেন। এখন বলুন, আপনার আগমনের উদ্দেশ্য কি?
***
‘আফ্রিকা ও মিসরের সম্মানিত আমীর!’ জুলিয়ান বললেন। আমি আপনার জন্য অরেকটি তোহফা এনেছি, এ তোহফা খোদ আপনাকে অগ্রসর হয়ে গ্রহণ করতে হবে। আমিও আপনার সফরসঙ্গী হব। চলার পথে কৃষ্ণসাগরের অথৈ জলরাশী বাধা হয়ে দাঁড়াবে। আমি আমার নৌবহর ও নাবিক আপনাকে দেব। তারা আপনার হুকুমে কাজ করবে।’
‘একমাত্র আল্লাহই আমাদের অন্তরের গোপন কথা জানেন।’ মুসা বিন নুসাইর বললেন। প্রথমত আপনার আগমনের উদ্দেশ্যই আমার নিকট স্পষ্ট নয়। তার উপর আপনি যে তোহফার কথা বলছেন, সেটা এতটাই রহস্যপূর্ণ যে, তা বুঝার মতো যোগ্যতা আমার নেই। আপনি আপনার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট ভাষায় বর্ণনা করলে আমার মতো সল্পবুদ্ধিসম্পন্ন লোকের পক্ষে বিষয়টি অনুধাবন করা সহজ হবে।
‘আমি যে তোহফার কথা বলছি, সেই তোহফার নাম, আন্দালুসিয়া। জুলিয়ান বললেন। ‘আন্দালুসিয়া যে এক অপূর্ব নৈসর্গিক সৌন্দর্যের দেশ। এ ব্যাপারে আপনি ভালোভাবেই অবগত আছেন। আপনি চাইলে এই রাজ্যকে ইসলামী সালতানাতের অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন। আন্দালুসিয়ার পর ফ্রান্স। আন্দালুসিয়ায় আপনি আপনার রাজত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করে ফ্রান্স আক্রমণ করতে পারবেন।
‘ইসলামী সালতানাতের সাথে আপনার এই আন্তরিকতা প্রদর্শনের কী কারণ থাকতে পারে? মুসা বিন নুসাইর বললেন। তাছাড়া আপনার স্বজাতি বাদশাহ রডারিকের সাথে আপনার এই হঠাৎ দুশমনিইবা কি কারণ ঘটতে পারে?
আপনার হয়তো জানা আছে, আমি বাদশাহ রডারিকের করদ-রাজা। জুলিয়ান বললেন। সে আমাকে আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। সে সর্বদা এই আশঙ্কা করে যে, আরব মুসলমানগণ অপরাজেয় এক সামরিক শক্তিরূপে যেভাবে আত্মপ্রকাশ করছে, মনে হয় তারা অতিসত্বর আন্দালুসিয়াকে পদানত করে ইউরোপে প্রবেশ করবে। তারা সময়ের সামান্য ব্যবধানে রোম-পারস্যের ন্যায় মহাশক্তিধর দুটি সাম্রাজ্যকে তছনছ করে দিয়েছে। বিভিন্ন রাজ্য জয় করতে করতে উত্তর আফ্রিকার সীমান্ত সৈকতে এসে পৌঁছেছে। অল্প সময়ের মধ্যে আফ্রিকার হিংস্র জাতি বাবার সম্প্রদায়কে ইসলাম ধর্মের অন্তর্ভুক্ত করে সুসংবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল এক সামরিক শক্তিতে পরিণত করেছে। আর এসব কিছুই হল রডারিকের ভয়ের কারণ। তাই আপনি যেন কখনও আন্দালুসিয়া আক্রমণ করতে না পারেন, সে জন্য রডারিক আমাকে আপনার পথেরাঁটা হিসেবে দাঁড় করিয়েছে।’