প্রফেসর ডোজি লেখেছেন, সকলের নীরবতার একটি কারণ এটিও হতে পারে যে, এই টেবিল সম্পর্কে ধর্মজাযকদের কাছ থেকে রহস্যময় ও লোমহর্ষক অনেক কথাই শোনা গিয়েছিল। তারা হয়তো মনে করছিলেন, চতুর্থ পায়াটি নিজে নিজেই অদৃশ্য হয়ে গেছে। কিংবা হয়তো অদৃশ্য হয়নি; কিন্তু তারা কেউই সেটা দেখতে পাচ্ছেন না। আর তাই সুনিশ্চিতভাবে কেউ কিছু বলতেও পারছিলেন না।
‘আমি এই টেবিলের সাথে চতুর্থ পায়া লাগিয়ে দেব।’ মুসা বিন নুসাইর বললেন। অন্য পায়াগুলোতে যেরকম হীরা-জহরত আর চুণিপাথর জড়ানো আছে, সেগুলো হয়তো পাওয়া যাবে না। তাতে কী হয়েছে? আমি স্বর্ণ দিয়ে চতুর্থ পায়াটি তৈরি করা। তারপর এই টেবিল আমি আমিরুল মুমিনীনের নিকট তোহফা হিসেবে পেশ করব। শহরের সবচেয়ে অভিজ্ঞ স্বর্ণকারকে ডেকে নিয়ে এসো। তাকে বল, অন্যান্য পায়ার মত দেখতে আরেকটি পয়া স্বর্ণ দিয়ে বানিয়ে দিতে। এমনভাবে পায়াটি বানাতে হবে, যাতে সহজেই সেটি টেবিলের সাথে লাগানো যায় এবং পৃথক করা যায়।’
ডন পাস্কেল নামক জনৈক ইতিহাসবিদ তঙ্কালীন নথিপত্রের বরাত দিয়ে লেখেছেন, অর্জিত গনিমতের মালের মধ্যে স্বর্ণের কোন কমতি ছিল না। চতুর্দিকে স্বর্ণের স্তূপ লেগে গিয়েছিল। মুসা বিন নুসাইরের নির্দেশ অনুযায়ী অভিজ্ঞ স্বর্ণকারকে ডেকে এন টেবিলের অন্য পায়াগুলো দেখানো হল। অল্প কয়েক দিনের মেহনতেই স্বর্ণকার টেবিলের চতুর্থ পায়া তৈরি করে লাগিয়ে দিল।
এর কয়েক দিন পরের ঘটনা। মুজাহিদ বাহিনী আরাগুনের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল এই বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন দুইজন। মুসা বিন নুসাইর আর তারিক বিন যিয়াদ। মুসা বিন নুসাইর জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন। আর তারিক বিন যিয়াদ পৌঁছেছেন যৌবনের শেষ প্রান্তে। কিন্তু আবেগ আর উদ্যম, সংকল্প আর সাহসিকতায় উভয়কেই নওজোয়ান মনে হচ্ছিল। তারা মুজাহিদ বাহিনীর সাথে যে পথ অতিক্রম করে চলছিলেন, সেটা কোন সহজ পথ ছিল না; বরং সেখানে কোন পথই ছিল না। মুজাহিদ বাহিনী দিগন্ত বিস্তৃত বিপদসংকুল ভয়ঙ্কর এক উপত্যকা অতিক্রম করে চলছিল।
মুসা বিন নুসাইর আর তারিক বিন যিয়াদের গন্তব্য ছিল আরাগুন রাজ্যের কেন্দ্রীয় শহর সারগোসা। এই গন্তব্য পর্যন্ত পৌঁছতে অসাধারণ হিম্মত আর অসম সাহসিকতার প্রয়োজন ছিল। এই শহরে পৌঁছার জন্য সর্বসাধারণ যে রাস্তা ব্যবহার করত, তা ছিল খুবই দীর্ঘ। কম করে হলেও এই রাস্তার দূরত্ব ছিল এক মাসের। কিন্তু মুসা বিন নুসাইর বিকল্প পথ হিসেবে উপত্যকা দিয়ে তার বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন।
এই উপত্যকা ছিল ‘হিজারা উপত্যকার মতোই দুর্গম আর বিপদসংকুল। এই উপত্যকায় সমতল ভূমিও ছিল। কিন্তু ঝোঁপ-জঙ্গল, আর উঁচু-নিচু টিলার সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। খানাখন্দ, খাল-বিল আর নদ-নদীর সংখ্যাও ছিল প্রচুর। কোন কোন নদী ছিল খুবই গভীর।
সৈন্যবাহিনীর সদসামগ্রী গরু-গাড়ি বা ঘোড়া-গাড়ির পরিবর্তে খচ্চরের উপর বোঝাই করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। কোন ধরনের গাড়ি নিয়ে এই এলাকা অতিক্রম করা ছিল একেবারেই অসম্ভব। সমগ্র বাহিনীর জন্য এক সাথে খানা তৈরি করার মত কোন পাত্রও সাথে করে নেওয়া হয়নি। প্রত্যেক সওয়ারীকে একটি করে তামার পাত্র দেওয়া হয়েছিল। সেই পাত্রে সে খানা তৈরি করত এবং পানি পান করত। প্রত্যেক সওয়ারীর কাছে একটি করে পানির মশক আর একটি করে শুকনো খাবারের থলি ছিল। পদাতিক সৈন্যদের পক্ষে কোন কিছু বহন করা সম্ভব ছিল না। পদাতিক সৈন্যের কাছে হাতিয়ার ছাড়া আর কোন কিছুই ছিল না। সওয়ারী সৈন্যদের বলে দেওয়া হয়েছিল, তারা যেন পদাতিক সৈন্যদেরকে তাদের পানাহারে শরিক করে। একজন সওয়ারী সৈনিক আরেকজন পদাতিক সৈনিকের সাথে মিলে যেন খানা খায়।
হিজারা উপত্যকা অতিক্রম করার সময় তারিক বিন যিয়াদের বাহিনী যেমন বিপদের সম্মুখীন হয়েছিল এই বাহিনীও পদে পদে তেমনি বিপদের সম্মুখীন হতে লাগল। গভীর নদীগুলো পার হতে গিয়ে দুই-চারজন মুজাহিদ স্রোতের টানে হারিয়ে গেল। জঙ্গলের যেখানে ছাউনি স্থাপন করা হয়েছিল, সেখানে কয়েকজন মুজাহিদ বিষাক্ত সাপের ছোবলে প্রাণ হারাল। কোন কোন মুজাহিদ কমর পর্যন্ত চোরাবালিতে ডেবে গেল। রশি ছুঁড়ে মেরে তাদেরকে সেখান থেকে উদ্ধার করা হল।
সবচেয়ে বড় ধৈর্যের পরীক্ষা ছিল একদিন একরাত যাবত বয়ে যাওয়া পাহাড়ী সাইক্লোন আর জীবনসংহারী ঝবায়ুর মাঝে তাদের টিকে থাকা। পাহাড়ী সাইক্লোন বিশাল বিশাল গাছগুলোকে দুমড়ে-মুচড়ে শিকড় থেকে উপড়ে ফেলছিল। মোটা মোটা ডালগুলো ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়ছিল। চার-পাঁচটি ঘোড়া একটি বড়সড় গাছে নিচে দাঁড়ানো ছিল। টর্নেডোর আঘাতে ঘোড়াগুলো এক মুহূর্তে পুড়ে ভস্ম হয়ে গেল। পূর্ণ একদিন একরাত অনবরত টর্নেডোর আঘাত মুজাহিদদের জন্য সবচেয়ে বড় বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিছুক্ষণ পর পর বজ্রপাতের বিকট শব্দ বোমা বিস্ফোরণের মতো মনে হচ্ছিল।
মুজাহিদ বাহিনীর কাছে কোন তবু ছিল না। তারা বজ্রপাতের ভয়ে গাছে নিচে আশ্রয় নিত না। তারা জানত গাছের উপরই বজ্রপাত ঘটে। তারা টিলা আর বালিয়াড়ির আড়ালে আশ্র নিল। কিন্তু প্রচণ্ড ঝড়ীবায়ু আর পাহাড়ী সাইক্লোনের আক্রোশ থেকে নিজেদেরকে নিরাপদ রাখা কিছুতেই সম্ভব হচ্ছিল না। খচ্চর আর ঘোড়াগুলো শীতের তীব্রতায় ঠক ঠক করে কাঁপছিল।