মুসা বিন নুসাইর এ জাতীয় আরও দু-একটি ঘটনা উল্লেখ করলেন। আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে তারিক বিন যিয়াদ আর কিছুই বললেন না। তবে তখন তিনি যা বলেছিলেন, তার সারমর্ম হল, মুসা বিন নুসাইরকে আমি শুধু আমার আমীরই মনে করি না। তাকে আমি বাবার মতই শ্রদ্ধা করি। মুসা বিন নুসাইর তারিক বিন যিয়াদকে আরও কিছুক্ষণ তিরস্কার করে ক্ষমা করে দিলেন।
তারিক বিন যিয়াদ সামনে অগ্রসর হয়ে মুসা বিন নুসাইরের ডান হাত তার দুই হাতের মধ্যে নিয়ে পরম ভক্তিভরে চুমু খেলেন এবং চোখে স্পর্শ করলেন।
‘ইবনে যিয়াদ।’ মুসা বিন নুসাইর বললেন। এমন একদিন আসবে যেদিন তোমার অস্তি-মজ্জা মাটির সাথে মিশে যাবে। হয়তো তোমার কবরের কোন চিহ্ন সেদিন অবশিষ্ট থাকবে না। কিন্তু যতদিন এই পৃথিবীর বুকে আন্দালুসিয়ার অস্তিত্ব থাকবে ততদিন তোমার নাম অবশিষ্ট থাকবে।’
মুসা বিন নুসাইরের কণ্ঠে তারিক বিন যিয়াদের কৃতিত্বের প্রতি স্নেহমিশ্রিত স্বীকৃতি ঘোষিত হওয়ার পর মুহূর্তে সম্পূর্ণ পরিবেশ একেবারে পাল্টে গেল। মনে হল, ঈশান কোণে জমে থাকা কালো মেঘের ভেলা সরে গিয়ে সেখানে সূর্যের আলোকরশ্মি ছড়িয়ে পড়ল।
ইউরোপিয়ান বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ও পর্যবেক্ষক আরদাফ্রেঞ্চ তার লিখিত ‘ফ্যালকন অফ স্পেন গ্রন্থে লেখেছেন, মুসা বিন নুসাইরের কথার স্বরে এমন পরিবর্তন পরিলক্ষিত হল যে, মনে হল, তারিক বিন যিয়াদ তার ঔরসজাত সন্তান। মুসা বিন নুসাইর সুনির্দিষ্ট কোন অভিলাষ নিয়েই আন্দালুসিয়া এসেছিলেন। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে তিনি তাঁর অভিপ্রায় পরিবর্তন করে নিলেন। সম্ভবত তিনি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন যে, তারিক বিন যিয়াদকে ছাড়া জয়যাত্রা অব্যাহত রাখা তাঁর পক্ষে সম্ভব হবে না। অবশ্য এ কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, আন্দালুসিয়া বিজয়ের ক্ষেত্রে মুসা বিন নুসাইরেরও যথেষ্ট অবদান রয়েছে। তিনি যখন এই ইচ্ছা ব্যক্ত করেন যে, ফ্রান্সকেও ইসলামি সালতানাতের অন্তর্ভুক্ত করবেন তখন তার উচ্চমার্গিয় চিন্তা-ভবনা আর দূরদৃষ্টির পরিচয় পাওয়া যায়।
মুসা বিন নুসাইর তারিক বিন যিয়াদকে ক্ষমা করার পর পরই আন্দালুসিয়ার অবিজিত অঞ্চলসমূহে অভিযান পরিচালনার পরিকল্পনা শুরু করে দেন।
‘সম্মানিত আমীর। তারিক বিন যিয়াদ মুসা বিন নুসাইরকে বললেন। আমি আপনার খেদমতে এখানকার তোহফা পেশ করতে চাই।’
মুসা বিন নুসাইর অনুমতি দিলে তারিক বিন যিয়াদ তোহফা নিয়ে আসতে বললেন। তিনি তালবিরা থেকে এই তোহফা সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন। ‘আন্দালুসিয়ার ইতিহাস নামক গ্রন্থে অসংখ্য ঐতিহাসিকদের বরাত দিয়ে লেখা আছে যে, তারিক বিন যিয়াদের নিয়ে আসা মহামূল্যবান উপহার সামগ্রী দেখে মুসা বিন নুসাইরের চোখে-মুখে বিস্ময়ের চিহ্ন ফুটে উঠে।
অধিকাংশ উপহার সামগ্রীই ছিল স্বর্ণের। সেগুলোর সাথে নানা বর্ণের অতিমূল্যবান উজ্জল নুড়ি পাথর আর হীরা-জহরত জড়ানো ছিল। এমন দুর্লভ আর মহামূল্যবান সামগ্রী কেবল রাজা-বাদশাহদের মহলেই শুভা পেয়ে থাকে।
তারিক বিন যিয়াদ একেকটি তোহফা দেখাচ্ছিলেন আর বলছিলেন, ‘এটা আপনার জন্য…, এটা আমিরুল মুমিনীনের জন্য।
অবশেষে তারিক বিন যিয়াদ সেই টেবিল বের করে মুসা বিন নুসাইরের সামনে রাখেন, যা তিনি টলেডো থেকে পলায়নরত ধর্মযাজকদের কাছ থেকে ছিনিয়ে রেখেছিলেন। এই টেবিলটি ছিল স্বর্ণের তেরি। টেবিলের পায়া আর চতুর্দিক ছিল উপর থেকে নিচ পর্যন্ত হীরা-জহরত আর দুর্লভ মণি-মাণিক্যে জড়ানো।
‘এই টেবিল সম্পর্কে বেশ কিছু কিংবদন্তি প্রচারিত আছে। তারিক বিন যিয়াদ বললেন। প্রথমটি হল, কোন এক যুগে টাইটিস নামক কোন এক বাদশাহ জেরুজালেমের উপর আক্রমণ করেছিলেন। সেখানকার সবচেয়ে বড় উপাসনালয় থেকে তিনি এই টেবিল হস্তগত করেছিলেন।
দ্বিতীয়টি হল, এই টেবিল হযরত সুলায়মান আলাইহিসসালামের মালিকানাধীন।
তৃতীয়টি হল, ধর্মজাযকরা বলেছেন, এই টেবিলের মালিকানা যে দাবি করবে তার পরিণতি হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। সে অসহনীয় লাঞ্ছনা-গঞ্জনার মধ্যে অসহায়ের মত মৃত্যু বরণ করবে।’
‘আমি এই টেবিলের মাঝে আরেকটি আশ্চর্য বিষয় দেখতে পাচ্ছি।’ মুসা বিন নুসাইর টেবিলটির চতুর্দিকে প্রদক্ষিণ করে বলে উঠলেন। এই টেবিলের তিনটি পায়া দেখা যাচ্ছে, চতুর্থ পায়াটি তো দেখতে পাচ্ছি না।’
‘সম্মানিত আমীর! এই টেবিলের পায়াগুলো অনায়াসে খোলা যায় আবার লাগানো যায়। তারিক বিন যিয়াদ বললেন। এত পুরাতন একটি টেবিল, কে জানে, কত রাজ্যে আর কত বাদশাহর দরবারেই না ছিল? কেউ হয়তো একটি পায়া খুলে নিয়েছেন। কিংবা কোথাও হয়তো হারিয়ে গেছে।
উপস্থিত সকলেই দেখতে পেল যে, টেবিলের একটি পায়া নেই। উপস্থিত লোকদের মধ্যে তারাও ছিল যারা পুর্বেও এই টেবিলটি দেখেছিল। জুলিয়ান আর আউপাসও টেবিলটি দেখেছিলেন। সকলেরই মনে হচ্ছিল, টেবিলের চারটি পায়াই টেবিলের সাথে অক্ষত অবস্থায় ছিল। অথচ এখন তারা দেখতে পাচ্ছেন, চতুর্থ পায়াটি নেই। কিন্তু তাদের কেউই এ ব্যাপারে মুখ খুললেন না। কেউই বললেন না যে, টেবিলটি যখন এখানে নিয়ে আসা হচ্ছিল তখন তার চারটি পায়াই অক্ষত ছিল। কিন্তু সকলেই এ ব্যাপার নীরব কেন ছিল, ইতিহাস থেকে এর কোন সঠিক উত্তর পাওয়া যায় না। তাদের সকলের নীরবতা তারিক বিন যিয়াদের কথারই সমর্থন করছিল।