‘সম্মানিত আমীর! মুগীস আর-রুমি জিজ্ঞেস করলেন। এই এক দিন, এক রাত বার্বারদেরকে কীভাবে শান্ত রাখা যায়?
‘তাদেরকে বলে দাও; বরং সেনাবাহিনীর মাঝে ঘোষণা করে দাও, তারিক বিন যিয়াদের মুক্তি বা শাস্তির ফায়সালা আগামীকাল হবে।’ মুসা বিন নুসাইর বললেন।
ঐতিহাসিকগণ লেখেছেন, সেনাবাহিনীর মাঝে যখন এ ঘোষণা করা হল তখন বার্বার সৈন্যরা শ্লোগান দিতে শুরু করল। তাদের সেই শ্লোগান শুধু শ্লোগান ছিল না; বরং আল্টিমেটাম ছিল।
‘আমরা তারিক বিন যিয়াদের মুক্তি চাই।’
‘আমরা তারক বিন যিয়াদের সাথে এসেছিলাম, তারিক বিন যিয়াদের সাথেই ফিরে যাব।’
‘তারিক বিন যিয়াদ যেখানে আমরাও সেখানে।
‘আমরা কিস্তি জ্বালিয়ে দিয়ে এসেছি, আন্দালুসিয়ার সব কিছু আগুনে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়ে যাব।’
‘তারিক বিন যিয়াদ নেই তো আমরাও নেই।
বার্বারদের এ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে মুসা বিন নুসাইরকে অবহিত করা হল।
***
পরদিন সকালে হাত-পায়ে বেড়ি পরা অবস্থায় তারিক বিন যিয়াদকে মুসা বিন নুসাইরের সামনে উপস্থিত করা হর। ঘোড়াগাড়িতে করে তারিক বিন যিয়াদকে নিয়ে আসা হল, যাতে কেউ তারিক বিন যিয়াদের এই অবস্থা দেখতে না পারে। মুসা বিন নুসাইর প্রথমেই তারিক বিন যিয়াদের হাত-পায়ের বেড়ি খুলে দেওয়ার হুকুম দিলেন।
বেড়ি খুলার পর মুসা বিন নুসাইর তারেক বিন যিয়াদকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি যখন তোমাকে সামনে অগ্রসর হতে নিষেধ করেছিলাম তখন তুমি আমার সেই হুকুম কেন অমান্য করেছিলে?
সেখানে জুলিয়ান ও আউপাসসহ চারজন সালার উপস্থিত ছিলেন। তারিক বিন যিয়াদ সকলের দিকে একবার দৃষ্টি ঘুরিয়ে এনে বললেন।
‘আমার সাথীরা এখানে উপস্থিত রয়েছেন, তাই অন্য কোন সাক্ষীর প্রয়োজন হবে না। যখন আপনার হুকুম আমার নিকট এসে পৌঁছে তখন আন্দালুসিয়ার বাহিনী আমাদের হাতে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে পলায়ন করছিল। অর্ধেকেরও বেশি সৈন্য নিহত হয়ে রণাঙ্গণে পড়েছিল। বাদশাহ রডারিক মৃত্যুবরণ করেছিল। অবশিষ্ট সৈন্যরা আশ-পাশের শহর-পল্লীতে আশ্রয় নিচ্ছিল। এ পরিস্থিতিতে আমি আমার সালারদেরকে জিজ্ঞেস করি, আমাদের আমীরের হুকুম মান্য করা আমাদের উচিৎ হবে কি না?
তারা সকলেই আমাকে এই পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, আমরা যদি শত্রুদের পিছু ধাওয়া না করি তাহলে তারা বিভিন্ন দুর্গে আশ্রয় নিয়ে যুদ্ধের জন্য পুনরায় প্রস্তুতি নিতে সক্ষম হবে। এই সম্ভাবনাও ছিল যে, পলায়নরত সিপাহীরা কোন স্থানে একত্রিত হয়ে যাবে, আর বিভিন্ন শহর থেকে তাদের কাছে যুদ্ধ-রসদ পৌঁছে যাবে।
অপর দিকে আমার বাহিনীর সিপাহীরাও যথেষ্ট পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। আপনি খুব সামান্য যুদ্ধ-রসদ পাঠিয়েছিলেন। আমি চাচ্ছিলাম, শত্রু বাহিনীকে ব্যস্ত রাখতে এবং কোন ভাবেই যেন তাদের কাছে যুদ্ধরসদ না পৌঁছে। আমার সকল সারারগণও আমাকে এই পরামর্শই দিয়েছিলেন।
জুলিয়ানও জোরালোভাবে বলেছিলেন, এখানে অবস্থান করা কিছুতেই ঠিক হবে না; বরং এতে সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। আমি নিজেও সামনে অগ্রস হওয়া উন্নত মনে করছিলাম। আর এ কারণে আমি যে সাফল্য অর্জন করেছি, তা হল আন্দালুসিয়ার দারুল হুকুমত এখন আপনার পদানত। আপনি যদি আমাকে কথা বলার সুযোগ দিতেন তাহলে আমি প্রথমেই আপনার সামনে এই পরিস্থিতির ব্যাখ্যা পেশ করতাম। কিন্তু আপনি আমাকে চাবুক দিয়ে আঘাত করাই বেশি জরুরি মনে করেছেন।
‘তুমি যে সাফল্য অর্জন করেছ, তা আমি স্বচক্ষে দেখতে পাচ্ছি। মুসা বিন নুসাইর বললেন। এ জন্য আমি তোমাকে শোকরিয়া জানাচ্ছি। তবে তোমার ভুল হল, তুমি পূর্বেই এ ব্যাপারে আমাকে অবহিত করনি? তুমি যদি আমাকে অবহিত করতে তাহলে আমি তোমার জন্য রসদ পাঠিয়ে দিতাম। অথচ স্বয়ং আমাকেই এখানে আসতে হয়েছে। আমার আশঙ্কা হচ্ছিল, তুমি আবেগের বশবর্তী হয়ে এমনভাবে ফেঁসে যাবে যে, সেখান থেকে বের হওয়া সম্ভব হবে না।’
‘ইবনে নুসাইর!’ জুলিয়ান বললেন। “ইবনে যিয়াদ যে জবানবন্দি দিয়েছেন, তা সম্পূর্ণরূপে সত্য। আমি তাঁকে বলেছিলাম, এই পদক্ষেপের কারণে আফ্রিকার আমীর যদি নাখোশ হন তাহলে আমি তাঁকে বুঝাতে সক্ষম হব। পরিস্থিতি এমন ছিল যে, আপনাকে অবহিত করার বিষয়টি আমাদের কারও মাথায়ই আসেনি। আমরা সকলেই আপনার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।’
‘ক্ষমা করার অধিকার একমাত্র আল্লাহর। মুসা বিন নুসাইর বললেন। ‘আমি তারিককে চাবুক দিয়ে যে আঘাত করেছি, তার অর্থ হল আমি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি।’
জুলিয়ান! আপনি জানেন না, ইসলামের বিধি-বিধান কতটা কঠিন। আপনি হয়তো শুনেছেন, খালেদ বিন ওলিদ রাযি. আপন সৌর্য-বীর্য আর রণকৌশলের কারণে তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামরিক শক্তিকে চিরতরে খতম করে দিয়েছিলেন। ইসলামী রাষ্ট্রের যতটা বিস্তৃতি তিনি ঘটিয়ে ছিলেন, অন্য কারও পক্ষে সেটা সম্ভব হয়নি। অত্যন্ত মামুলি একটি বিষয়ে হযরত ওমর রাযি. তাকে মসজিদে বসিয়ে সকলের সামনে তিরস্কার করেছিলেন। দ্বিতীয়বার তেমনি তুচ্ছ একটি বিষয়ে তাকে সেনাপতির দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছিলেন। অন্যান্য রাজা-বাদশাহরা এত বড় মাপের একজন সেনাপতির বড় বড় দোষ-ত্রুটিগুলোকেও ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতেন, কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন।