একজন ইউরোপিয়ান ঐতিহাসিক বাজোৰ্থ স্মিথ আরব ইতিহাসবিদ এবং তৎকালীন সময়ের অপ্রকাশিত কিছু নথিপত্রের বরাত দিয়ে লেখেছেন যে, তারিক বিন যিয়াদ তার কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সুউচ্চ মানসিকতার পরিচয় তো দিয়েছিলেনই; কিন্তু মুসা বিন নুসাইরও নীচু মানসিকতা সম্পন্ন কোন ব্যক্তি ছিলেন না। তারিক বিন যিয়াদ মুসা বিন নুসারিকে তাঁর বাবার মতো শ্রদ্ধা করতেন। মুসা বিন নুসাইরও তারিক বিন যিয়াদকে আপন সন্তানের মতোই স্নেহ করতেন। তারিক বিন যিয়াদের প্রতি মুসা বিন নুসাইরের এই রাগ বেশি দিন বহাল ছিল না।
এক রাতে মুসা বিন নুসাইরকে জানানো হল, বার্বার সিপাহীরা আরব সিপাহীদের বিরুদ্ধে এমনিতেই ক্ষেপে আছে। তারিক বিন যিয়াদের সাথে যে আচরণ করা হয়েছে, তার জের ধরে যে কোন মুহূর্তে তারা বিদ্রোহ করে বসতে পারে। মুসা বিন নুসাইরের প্রশাসন সম্পর্কে বার্বারদের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে। কোন আরব সেনাপতি বা উচ্চপদস্থ কোন কর্মকর্তা যদি বার্বারদের বিরুদ্ধে কোন রকম পদক্ষেপ গ্রহণ করে তাহলে গৃহযুদ্ধ লেগে যেতে পারে। গৃহযুদ্ধ লাগলে বার্বারদেরই বিজয় হবে। বার্বার মুজাহিদগণ তারিক বিন যিয়াদকে তাদের আধ্যাত্মিক রাহবার মনে করে।
‘মিসর ও আফ্রিকার আমীর! জুলিয়ান মুসা বিন নুসাইরকে লক্ষ্য করে বললেন। আপনার কোন সিদ্ধান্তের উপর কোন রকম হস্তক্ষেপ করা আমরা সঠিক মনে করি না, তবে আমি ও আউপাস যেভাবে আপনার বাহিনীকে পথ দেখিয়ে আন্দালুসিয়া নিয়ে এসেছি, আউপাস যেভাবে জীবনবাজি রেখে গোথ ও ইহুদি সম্প্রদায়কে রডারিকের বাহিনী থেকে পৃথক করে তাদেরকে রডারিকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে উদ্বুদ্ধ করেছে, তাতে করে আমরা মনে করি, আমাদের এই অধিকার আছে যে, আমরা আপনার এই সিদ্ধান্ত সম্পর্কে নিজেদের মত প্রকাশ করতে পারি।’
‘সম্মানিত আমীর!’ আউপাস বললেন। “গোয়াডিলিটের বিভীষিকাময় রণাঙ্গণে সহস্রাধিক গোথ সিপাহী স্বপক্ষ ত্যাগ করে তারিক বিন যিয়াদের সাথে যদি মিলিত না হত তাহলে গোয়াডিলিটের যুদ্ধের ফলাফল ভিন্ন রকম হত। আমার কথার উদ্দেশ্য এই নয় যে, গোথ সৈন্যদের কারণেই মুসলিম বাহিনী জয় লাভ করেছে, বরং তারিক বিন যিয়াদের অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা আর অসম সাহিসকতাই যুদ্ধ জয়ের কারণ ছিল। তারিক বিন যিয়াদের জায়গায় যদি দুর্বল মনের অন্য কোন জেনারেল থাকত, আর তার সাথে এর চেয়েও দ্বিগুন গোথ সিপাহী এসে মিলিত হত তাহলেও রডারিকের বাহিনীকে পরাজিত করতে পারত না। একমাত্র তারিক বিন যিয়াদের পক্ষেই সম্ভব ছিল রডারিকের মত অভিজ্ঞ যুদ্ধবাজ জেনারেলকে পরাজিত করা।’
‘আমরা আশা করি, জুলিয়ান বললেন। আপনি এমন একজন মহামূল্যবান ব্যক্তিকে ধ্বংস করে দেবেন না।’
‘সম্মানিত আমীর! সালার মুগিস আর-রুমি বললেন। আপনাকে তো এ ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে যে, যত আশঙ্কা বার্বারদের পক্ষ থেকেই। প্রকৃত তথ্য হল, বার্বারদের পক্ষ থেকে আশঙ্কার বিষয়টি শুধু কথার কথা নয়। তারা বাস্তবেই কোন না কোন অঘটন ঘটিয়ে বসবে। আপনি তাদের ব্যাপারে ভালভাবেই অবগত আছেন। আমি বার্বারদের নেতৃত্ব দিয়েছি। আমি জানি, রণাঙ্গণে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণে রাখা কতটা বিপদজনক। তারা রণাঙ্গণ থেকে পালাতে জানে না। পালিয়ে বাঁচার পরিবর্তে হাসি মুখে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নেয়। শত্রুকে সামনে পেলে উন্মাদ হয়ে যায়। শত্রুকে টুকরো টুকরো করা ব্যতীত তারা শান্ত হয় না।
আমার কথার উদ্দেশ্য হল, তারা যদি বিদ্রোহ করে বসে তাহলে কী পরিণতি হবে, তা আপনি সহজেই অনুমান করতে পারেন। আন্দালুসিয়ার বাহিনী তাদের সাথে মিলে যাবে। তখন আমরা বাঁচতে পারব না, বার্বাররাও বাঁচতে পারবে না। বিজিত আন্দালুসিয়া আমাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হবে। আমি রাতের বেলা গোপনে বার্বারদের কথা শুনেছি। আমি আপনাকে সতর্ক করছি, তারিক বিন যিয়াদকে মুক্ত করে স্বপদে ফিরিয়ে না আনলে বার্বাররা বাস্তবেই বিদ্রোহ করে বসবে। আমি আপনাকে আরও বলতে চাই যে, আরব সেনাকর্মকর্তা ও মুজাহিদগণও তারিক বিন যিয়াদের অপসারণে সম্ভষ্ট নয়।
‘আমি আপনাকে বলতে চাই, তারিক বিন যিয়াদ কেন আপনার হুকুম মানেননি।’ সালার আবু জুরুয়া তুরাইফ বললেন।
‘সে কথা আমি তোমাদের মুখে নয়, স্বয়ং তারিক বিন যিয়াদের মুখেই শুনতে চাই।’ মুসা বিন নুসারি বললেন। “তোমরা কি মনে করছ, তোমরা যে আশঙ্কার কথা বলছ, তা আমি জানি না? তোমরা কি জান না যে, ইসলাম আমীরের নির্দেশ অমান্যকারীকে ক্ষমা করে না। তোমরা কি আমাকে বেয়াকু মনে করছ? তোমরা কীভাবে ধারণা করলে যে, আমি তারিক বিন যিয়াদের বিজয়ের কৃতিত্বকে ধুলিসাৎ করে দেব। তার কৃতিত্ব আমার নিজের কৃতিত্ব বলে চালিয়ে দেব? আল্লাহই ভাল জানেন, কার কৃতিত্ব কতটুকু। আমি মানুষকে আমার কৃতিত্ব দেখাতে চাই না। আমি শুধু আল্লাহর দরবারে আমার কর্মফল পেশ করতে চাই। তারিক বিন যিয়াদকে আজকের দিন আর রাতটি কয়েদখানায় থাকতে দাও। কাল সকালে তাকে আমার কাছে নিয়ে এসো। আমাদেরকে আরও সামনে অগ্রসর হতে হবে। সামনে ফ্রান্স। আমি জানতে পেরেছি, সেখানকার সৈন্যরা আন্দালুসিয়ার সৈন্যদের চেয়েও বেশি লড়াকু।