***
তারিক বিন যিয়াদ তো আশঙ্কার কথা প্রকাশ করেছিলেন মাত্র। তাঁর সেই আশঙ্কা বাস্তব রূপ লাভ করতে শুরু করে দিয়েছিল। টলেডোতে অবস্থানরত যে সৈন্যই জানতে পারছিল, আন্দালুসিয়ার অর্ধেকের বেশি অংশের বিজেতা তারিক বিন যিয়াদকে আফ্রিকার আমীর মুসা বিন নুসাইর খোলা ময়দানে সকলের সামনে চাবুক দিয়ে আঘাত করেছেন, তার মনেই এই প্রশ্ন সৃষ্টি হচ্ছিল যে, মুসা বিন নুসাইর এমনটি কেন করলেন? তারিক বিন যিয়াদের অপরাধ-ই বা কি ছিল?
কারো কাছেই এ প্রশ্নের কোন উত্তর ছিল না। খুব অল্প সময়ের মধ্যে সেনাবাহিনীর মধ্যে কিছু গুজব ছড়িয়ে পড়ল। এ নিয়ে একজন আরেকজনের সাথে তর্কে জড়িয়ে পড়ল। টলেডোর সেনাবাহিনীর প্রায় নব্বই ভাগই ছিল বার্বার সম্প্রদায়ের। বাবার সম্প্রদায়ের সৈন্যদের মাঝে দাবানলের ন্যায় ক্রোধের আগুন ছড়িয়ে পড়ল। সৈন্যবাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তারা রাগে-ক্ষোভে একেবারে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলেন।
তারিক বিন যিয়াদ তালবিয়ায় যে বাহিনী রেখে এসেছিলেন তাদের সকলেই ছিল বাবার সম্প্রদায়ের। টলেডোর সেনাসদস্যদের মাঝে এ গুঞ্জন স্পষ্টই না যাচ্ছিল যে, যেসকল বার্বার সৈন্য সামনে অগ্রসর হয়ে গেছে, তাদের কাছে এই সংবাদ পৌঁছে দাও, ‘মুসা বিন নুসাইর অন্যায়ভাবে তারিক বিন যিয়াদকে সকলের সামনে বেত্রাঘাত করেছেন।’
বিদ্রোহের সবচেয়ে বড় আশঙ্কা তারিক বিন যিয়াদের পক্ষ তেকেই ছিল। তাঁকে বন্দী করে সেই কারাগারে রাখা হয়েছিল, যেখানে তারই নির্দেশে আন্দালুসিয়ার বেশ কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তাকে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। তারা তারিক বিন যিয়াদকে বন্দী অবস্থায় দেখে উপহাস করতে শুরু করল। তাদের ঠাট্টা-বিদ্রুপের কারণে তারিক বিন যিয়াদের মনে দুঃখ-যন্ত্রণার যে ঝড় বইছিল, তা অনুমান করা কারো পক্ষেই অসম্ভব ছিল না। কিন্তু তারিক বিন যিয়াদ ছিলেন সম্পূর্ণ নিশ্চুপ। কথায় বা কাজে কোনভাবেই তিনি কোন কিছুর প্রতিবাদ করলেন না। তার চেহারা দেখে বুঝাই যাচ্ছিল না, তিনি কী ধরনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবেন?
তারিক বিন যিয়াদ এই পরিস্থিতি থেকে কীভাবে মুক্তি পেলেন–সে ব্যাপারে ঐতিহাসিকদের মাঝে বিস্তর মতপার্থক্য দেখা যায়। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক স্প্রিংগার, লেনপুল ও ডোজি লেখেছেন যে, মুসা বিন নুসাইর খলীফা ওলিদ বিন আবদুল মালেককে সম্পূর্ণ ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করার জন্য একজন কাসেম দামেস্কে পাঠিয়েছিলেন। সেই কাসেদ মারফত খলীফা পয়গাম পাঠিয়ে ছিলেন যে, তারিক বিন যিয়াদকে সেনাপ্রধানের পদে পুনর্বহাল করা হোক।
অন্য তিনজন ঐতিহাসিক লেখেছেন, তারিক বিন যিয়াদ কারাগার থেকে গোপন তৎপরতার মাধ্যমে তার শুভাকাঙ্ক্ষীদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তিকে দামেস্ক পাঠিয়ে দেন। সেই ব্যক্তিকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল যে, সে খলীফার সাথে সাক্ষাৎ করে তার সামনে তরিক বিন যিয়াদের বিজয়-অভিযান সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করবে। তারপর বলবে, মুসা বিন নুসাইর তারিক বিন যিয়াদকে সকলের সামনে চাবুক মেরে শুধু অপমানই করেননি, বরং তিনি তাঁকে বন্দী করে কারাগারে নিক্ষেপ করেছেন। মোটকথা, এই ব্যক্তির উপর দায়িত্ব ছিল, তিনি খলীফাকে বুঝাবেন যে, তারিক বিন যিয়াদের সাথে এই আচরণ করার কারণ হল, তিনি বাবার সম্প্রদায়ের লোক। মুসা বিন নুসাইর চান আন্দালুসিয়ার মাটিতে শুধুমাত্র আরবদের প্রাধান্য বিস্তার লাভ করুক। তিনি আন্দালুসিয়ার বিজয়ের কৃতিত্ব এককভাবে নিজের দখলে রাখতে চান।
একজন ঐতিহাসিক এ দাবি করেছেন, যে ব্যক্তিকে দামেস্ক পাঠানো হয়েছিল, তাকে প্রচুর ঘুষ প্রদান করা হয়েছিল। সে দামেস্ক পৌঁছে খলীফার কাছ থেকে তারিক বিন যিয়াদের মুক্তির নির্দেশ নিয়ে আসে।
বাস্তবতার নিরিখে এ দুটি বিবরণকেই অসহ্য মনে হয়। কারণ, কোন্ডে ও স্পর্থের মতো ইতিহাসবিদদ্বয় নির্ভরযোগ্য ও যুক্তিগ্রাহ্য দলিল-প্রমাণের ভিত্তিতে এ কথা সাব্যস্ত করেছেন যে, খলীফাকে অবহিত করার জন্য মুসা বিন নুসাইর কোন কাসেদ পাঠাননি এবং তারিক বিন যিয়াদও কাউকে ঘুষ দিয়ে মুক্তির জন্য কোন রকম গোপন তৎপরতা চালাননি। তাদের যুক্তি হল, ঘোড়ায় চড়ে টলেডো থেকে দামেস্ক যেতে ও আসতে কয়েক মাস লেগে যাওয়ার কথা। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী আছে যে, তারিক বিন যিয়াদকে অপসারণ করার অল্প কয়েক দিন পরই মুসা বিন নুসাইর ও তারিক বিন যিয়াদের সম্মিলিত নেতৃত্বে একটি সৈন্যবাহিনীকে ফ্রান্সের সীমান্ত এলাকায় অভিযান পরিচালনা করতে দেখা গেছে।
এটা তা বিশ্বাসই করা যায় না যে, তারিক বিন যিয়াদ কাউকে ঘুষ দিয়ে দামেস্ক পাঠাতে পারেন। তারিক বিন যিয়াদের কৃতিত্বকে খাট করতে পারে এমন কোন পদক্ষেপের নাম-গন্ধও তার কর্মকাণ্ডে ছিল না। তারিক বিন যিয়াদের সুউচ্চ মানসিকতার পরিচয় এ থেকেই পাওয়া যায় যে, তিনি তার আমীরের হাতে একর পর এক চাবুকের আঘাত নীরবে সহ্য করেছেন। তিনি যদি কোন ভুল পদক্ষেপ নিতে চাইতেন তাহলে তখনি বাবার সম্প্রদায়কে মুসা বিন নুসাইরের বিরুদ্ধে উস্কে দিতে পারতেন। সেনাবাহিনীর সংখ্যাগরিষ্ঠ সংখ্যা ছিল বাবার সম্প্রদায়ের। তারা চাইলে এক দিনেই আরবদের থেকে হাতিয়ার ছিনিয়ে নিয়ে আন্দালুনিয়ার বিজয়ী জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারত। কিন্তু তারিক বিন যিয়াদ এমন কোন পদক্ষেপের কথা চিন্তাই করেননি।