‘তুমি কি এজেলুনার কথা বলছ?’ আবদুল আযীয জাদুকরকে থামিয়ে দিয়ে বললেন।
‘হা…’ জাদুকর বলল। আমি তার কথাই বলছি।
‘তুমি ইহুদি।’ আবদুল আযীয বললেন। মৃত্যুকে চোখের সামনে দেখেও তুমি ধোঁকাবাজির আশ্রয় নিচ্ছ। তুমি কি বেঁচে থাকতে চাও না?’
‘আমিও আপনাকে এই প্রশ্নই করতে চাই।’ জাদুকর বলল। আপনি কি বেঁচে থাকতে চান না? আমি জানি, আপনি কী জবাব দেবেন। আপনাকে সতর্ক করছি, আপনার মাথা বেশিদিন আপনার শরীরের সাথে থাকবে না। এজেলুনা বেঁচে থাকবে। আমি আপনাকে বলছি, আন্দালুসিয়া মুসলমানদের হাতে আসবে ঠিক; কিন্তু মুসলমান বাদশাহ একে অপরের রক্ত ঝরাবে। আমার এই সত্য কথায় যদি আপনি দুঃখ পেয়ে থাকেন, তাহলে আমাকে হত্যা করার নির্দেশ দিন।’
‘আমাদের ধর্ম ইহুদিদের ভবিষ্যদ্বাণী ও জাদুকে বিশ্বাস করে না। আবদুল আযীয বললেন। আমরা আল্লাহকে বিশ্বাস করি। একমাত্র তারই ইবাদত করি। যদি আমি তোমার কথা বিশ্বাস করি তাহলে আমি মুশরিক হয়ে যাব।’
‘এটা ধর্মের বিষয় নয়, সম্মানিত সালার। জাদুকর বলল। এই বিশ্বজগতের অমোঘ রহস্যের সাথে মানুষের যে সম্পর্ক, তার সাথে ধর্মের কোন সংযোগ নেই। আমি আমার কথা আপনাকে বিশ্বাস করাতে পারব না, তবে আমি আপনাকে সতর্ক করে দিলাম।
আবদুল আযীয মনে করলেন, ইহুদি জাদুকর এজেলুনাকে তার হাতে হত্যা করাতে চায়। অথবা জাদুকরের ইচ্ছা হল, আবদুল আযীয এজেলুনাকে তালাক দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিক। আবদুল আযীয এসব কথা চিন্তা করে নির্দেশ দিলেন, যেন অতিসত্বর জাদুকর ও জায়গিরদারসহ সকল বন্দীকে হত্যা করে ফেলা হয়।
***
তালবিরা অবস্থান করার সময়ই তারিক বিন যিয়াদের নিকট মুসা বিন নুসাইরের পয়গাম এসে পৌঁছে। তারিক বিন যিয়াদ এমন নির্দেশের অপেক্ষায় ছিলেন। পয়গাম পৌঁছা মাত্রই তিনি তার রক্ষিবাহিনীর কয়েকজন ঘোড়সওয়ারকে সাথে নিয়ে টলেডোর উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যান। গনিমতের যেসব মূল্যবান তোহফা খলীফা ও আমীর মুসা বিন নুসাইরকে দেওয়ার জন্য তিনি পৃথক করে রেখেছিলেন, সেগুলোকে কয়েকটি খচ্চরের উপর বোঝায় করে নিয়ে আসছিলেন।
তারিক বিন যিয়াদ তালবিরা থেকে সোজা পথে টলেডোর দিকে রওনা হন। তিনি পথে খুব সামান্য সময়ের জন্য যাত্রা বিরতি দিয়ে খুব দ্রুত অগ্রসর হচ্ছিলেন। কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি টলেডো এসে পৌঁছেন। তারিক বিন যয়াদ যন শহরের ফটক দিয়ে প্রবেশ করছিলেন তখন মুসা বিন নুসাইরকে তাঁর আগমনের সংবাদ দেওয়া হল। সংবাদ পাওয়ামাত্র মুসা বিন নুসাইর চাবুক হাতে নিয়ে বের হয়ে এলেন।
তারিক বিন যিয়াদ মুসা বিন নুসাইরকে দেখামাত্র ঘোড়া থেকে নেমে দ্রুত পায়ে মুসা বিন নুসাইরের সামনে এসে বিনিত ভঙ্গিতে দুই বাহু প্রসারিত করে দিলেন। তিনি আশা করেছিলেন, তার বিজয়ে সন্তুষ্ট হয়ে মুসা বিন নুসাইর তাকে বুকে টেনে নিবেন। তার কপালে চুমু খেয়ে তাকে শোকরিয়া জানাবেন। কিন্তু মুসা বিন নুসাইরের আচরণ দেখে উপস্থিত সকলেই নির্বাক হয়ে গেল। ইতিহাসের বুকে আগুনের হরফে সে আচরণের কথা চিরকাল লেখা থাকবে।
তারিক বিন যিয়াদ কাছে আসতেই মুসা বিন নুসাইর সর্বশক্তি দিয়ে তারিক বিন যিয়াদকে লক্ষ্য করে চাবুক দিয়ে আঘাত হানেন। মুহূর্তেই তারিক বিন যিয়াদ পাথরের মূর্তির ন্যায় নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। মনে হল, সময়ের গতি থমকে গেছে। আশে-পাশে যারা ছিল তারা সকলেই নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
চারদিকে এতটাই নীরবতা ছেয়ে গেল যে, মনে হল, গাছে গাছে কোলাহলরত পাখিগুলো আচমকা বাকহীন হয়ে গেছে।
‘নাফরমান!’ মুসা বিন নুসাইরের তীব্র চিৎকারে নীরবতা ভেঙ্গে গেল। তিনি আবারও তারিক বিন যিয়াদকে চাবুক দিয়ে আঘাত করে বললেন, ‘আমি তোমাকে নির্দেশ দিয়েছিলাম, যেখানে আছ সেখানেই থাক। সামনে অগ্রসর হওয়ার দরকার নেই।
মুসা বিন নুসাইর আরেকবার চাবুক দিয়ে আঘাত করে বললেন, কিন্তু তুমি গোটা রাজ্য জয় করার জন্য উঠে-পড়ে লাগলে, আমার নির্দেশের কোন পরওয়াই করলে না?’
তারিক বিন যিয়াদ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চাবুকের আঘাত সহ্য করছিলেন। আর মুসা বিন নুসাইর একের পর এক আঘাত করে চলছিলেন। তিনি ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে বললেন, “আমি তোমাকে এই মুহূর্তে সিপাহসালারের পদ থেকে বরখাস্ত করছি।’
মুসা বিন নুসাইর তার সিদ্ধান্ত শুনিয়ে দিয়ে আশ-পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সালারদেরকে হুকুম দিলেন। একে কয়েদখানায় নিয়ে যাও। আমি একে মুক্ত দেখতে চাই না।’
দু’জন সিপাহী সামনে অগ্রসর হল। একজন তারিক বিন যিয়াদের ডান বাহু, আর অপরজন বাম বাহু ধরে তাঁকে সেখান থেকে নিয়ে গেল।
ইবনে যিয়াদ! আমাদেরকে ক্ষমা করবেন।’ চলতে চলতে একজন সিপাহী বলল। আমরা আমীরের নির্দেশ মানতে বাধ্য।
‘এমন আচরণ করা আমীরের উচিত হয়নি।’ অপর সিপাহী বলল।
বন্ধুগণ! আমি আল্লাহ তাআলার হুকুম মানতে বাধ্য। তারিক বিন যিয়াদ কান্নাবিজড়িত কণ্ঠে বললেন। আল্লাহ তাআলার হুকুম হল, আমীরের আনুগত্য করা। অন্যথায় আমি যদি বার্বারদের ইশারা করি তাহলে আরবদের নাম-নিশানাও পাওয়া যাবে না। আমার ভয় হচ্ছে, বার্বার সম্প্রদায় আমার এত বড় অপমান সহ্য করতে পারবে না। আমাকে যদি বন্দী করে রাখা হয় তাহলে তোমরা এবং আমীর মুসা কেউই বার্বারদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না।