আরেকজন বলল, আমরা এটাই জানতে এসেছিলাম।
আমার মনিব বলল, এজেলুনাকে জীবিত রাখা ঠিক হবে না। সে আমাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদেরকে ধরিয়ে দিয়ে হত্যা করিয়েছে।
জাদুকর বলল, আমি তোমাদের উপর কোন অনুগ্রহ করতে আসিনি। আমি প্রতিশোধের আগুনে জ্বলতে জ্বলতে এখানে এসেছি। ইহুদিরা এই রাজ্যে নিজেদের জন্য সম্মানজনক জায়গা তৈরি করে নিয়েছিল। মুসলমানরা ইহুদিদেরকে সম্মানজনক পদমর্যাদা দিয়েছিল। বিভিন্ন জায়গিরদারীর ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। সবকিছু ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। আর এ জন্য দায়ী হল, শয়তান এজেলুনা। এই বদনসীবের জানা নেই যে, ইহুদিরা মাটির নিচ দিয়ে আক্রমণ করে। আমরা অবশ্যই বিজয়ী হব। এখানে আবারও কুশের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। আমাদের বিজয়ের নিদর্শন হল, আমরা এমন একজন মেয়ে পেয়ে গেছি, যে কোন রকম বাধা ছাড়াই এজেলুনা পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে।’
আবদুল আযীযের চেহারা রাগে রক্তবর্ণ ধারণ করল। এজেলুনার হাত কাঁপতে লাগল।
‘তার পর কি হয়েছে?’ আবদুল আযীয জিজ্ঞেস করলেন। তাড়াতাড়ি বল, আমরা তোমাকে পুরস্কৃত করব।
কিছুক্ষণ পর নাদিয়া চুক গিলে বলতে শুরু করল। “জাদুকর আমার কামরায় প্রবেশ করল। আমার অবস্থা এই দাঁড়িয়ে ছিল যে, ভয়ে আমার শরীর কাঁপছিল। প্রথমে আমি চিন্তা করেছিলাম, জাদুকর আসার আগেই আমি পালিয়ে যাব। পরে ভেবে দেখলাম, আমি যদি পালিয়ে যাই তাহলে তারাও সরে পড়বে। জাদুকর এসে প্রতিদিনের ন্যায় আমার উপর তার জাদু প্রয়োগ করতে শুরু করল। সে আমাকে বলল, এজেলুনার চেহারা কল্পনায় তোমার সামনে উপস্থিত কর। তখন রানীর চেহারা কল্পনায় আনলাম না। অন্যান্য দিনের মত আজও সেই বাক্যগুলো উচ্চারণ করলাম ঠিকই; কিন্তু নিজেকে পূর্ণরূপে সজাগ রাখলাম। কিছুক্ষণ পর জাদুকরের আমল শেষ হল।
এটা গত রাতের ঘটনা। সকালে আমি আমার মনিবের কাছে শহরে আসার অনুমতি চাইলাম। সে কোচওয়ানসহ ঘোড়া দিয়ে দিল। আমি কোচওয়ানকে শহরের প্রধান ফটক হতেই বিদায় করে দিয়েছি। তাকে বলেছি, আমি সন্ধ্যার সময় ফিরে আসব। কোচওয়ানকে আরও বলেছি, মনিবকে বলবে, প্রতিদিন আমরা যেখানে যাই, সেখানে যাওয়ার অনেক আগেই আমি এসে পড়ব।
আমি আপনাদের দুজনকে এ সংবাদ দেয়ার জন্যই এসেছি। আমি রানীকে এই অনুরোধ করব না যে, তিনি আমাকে পুনরায় তার খেদমতে নিয়োজিত করুন। আমি রানীর মহব্বত ও ভালোবাসার প্রতিদান দিতে এসেছি। রানী আমার প্রতি অনেক অনুগ্রহ করেছেন। আমি যে অন্যায় করেছি, তার শাস্তি হিসেবে রানী ইচ্ছে করলে আমাকে হত্যা করে ফেলতে পারতেন। কেউ তাকে কোন কিছু জিজ্ঞেসও করত না। কিন্তু তিনি তা করেননি, বরং তিনি আমাকে নিরাপদে শহর থেকে বের হয়ে যেতে বলেছেন। রানীর প্রতি আমার মনে যে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা রয়েছে, তা কোন দিন নিঃশেষ হবে না এবং বিন্দুমাত্র কমবেও না। আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি মাত্র …।
‘তুমি সন্ধ্যার পূর্বেই ফিরে যাবে।’ আবদুল আযীয নাদিয়াকে বললেন। ‘আমি তোমাকে আমার সওয়ারী দিতে পারি; কিন্তু তাতে তোমার উপর সন্দেহ সৃষ্টি হবে। তুমি আমাদেরকে সে গ্রামের রাস্তা এবং যে ঘরে জাদুকর বাস করে তার ঠিকানা বলে দাও। তুমি সন্ধ্যার পর তোমার মুনিবের সাথে জাদুকরের কাছে পৌঁছে যাবে। বাকী কাজ আমাদের উপর ছেড়ে দাও।
‘নাদিয়া!’ এজেলুনা বলল। তুমি আমার ভালোবাসা ও মহব্বতের হক আদায় করেছ। আমিও তোমার মহব্বতের হক আদায় করব।’
***
সেদিন রাতে নাদিয়া জাদুকরের সামনে বসেছিল। নাদিয়ার মনিব পাশের কামরায় তিন-চারজন লোকের সাথে বসে গল্প করছিল। জাদুকর তার জাদু প্রয়োগ করছিল। এমন সময় দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ হল। এক ব্যক্তি উঠে দরজা খুলে সাথে সাথে দরজা বন্ধ করে দিল। বাহির থেকে এত জোরে দরজায় ধাক্কা দেওয়া হল যে, বিকট শব্দে দরজা খুলে গেল। যে ব্যক্তি দরজা বন্ধ করতে চাচ্ছিল, সে দরজার ধাক্কা খেয়ে চিত হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। বিশ-পঁচিশজন জানবাজ মুজাহিদ ঘরের ভেতর প্রবেশ করে সকলকে ঘিরে ফেলল। পুরো গ্রামে এই বাড়িটি ছিল সবচেয়ে বড় এবং জাঁকজমক পূর্ণ। মুজাহিদ বাহিনী গোটা গ্রাম অবরোধ করে নিয়েছিল। মুজাহিদ বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন স্বয়ং আবদুল আযীয়।
জাদুকরসহ ঘরে যেসব লোক ছিল সকলকে গ্রেফতার করা হল। জাদুকরের জাদুর বাক্স থেকে মানুষের মাথার খুলি, আর কয়েকটি হাড়গোড় বের হল। কিছু তেলেসমাতির সামানপত্রও বের হল, যা সকল জাদুকরের কাছেই পাওয়া যায়। নাদিয়াকেও তাদের সাথে গ্রেফতার করা হল, যাতে কারও সন্দেহ না হয় যে, নাদিয়ার কারণেই সকলকে গ্রেফতার করা হয়েছে। নাদিয়াকে সবধরনের সন্দেহ থেকে মুক্ত রাখার জন্য গ্রামের গণ্যমান্য কয়েকজন ব্যক্তিকেও গ্রেফতার করা হল। গ্রেফতারের পর তাদের সকলকে মেরিডার জেলখানায় পাঠিয়ে দেওয়া হল।
‘আবুল হাসান!’ আবদুল আযীয তার একজন পুলিশ অফিসারকে ডেকে বললেন। একজন ইহুদি জাদুকর এবং একজন খ্রিস্টান জায়গিরদার থেকে তাদের অপরাধের স্বীকারোক্তি আদায় করতে হবে।’
আবদুল আযীয পুলিশ অফিসারের সাথে তাদের অপরাধের ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করলেন। পুলিশ অফিসার আবুল হাসান তাদেরকে জেলখানার ভূ-গর্ভস্থ একটি কুঠরীতে নিয়ে গেল। কোন রাজা-বাদশাহ বা গণ্যমান্য ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হলে এ সকল ভূ-গর্ভস্থ কুঠরীতে আটকে রেখে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দিয়ে তাদেরকে মেরে ফেলা হয় বা অপরাধের কথা স্বীকার করানো হয়। যাকে একবার ভূ-গর্ভস্থ কুঠরীতে নেওয়া হত, তার পক্ষে জীবন নিয়ে ফিরে আসা একেবারে অসম্ভব ছিল।