কিছুক্ষণ পর এই স্বপ্ন বা কল্পনা শেষ হয়ে গেল। আমি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলাম। আমি জাদুকরকে বললাম, আমার উপর কি ধরনের অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল। সে বলল, যদি এ অবস্থা সৃষ্টি হয়ে থাকে তাহলে তুমি সফল হবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমার জাদুও সফল হবে। তোমার কাজ হল, তুমি প্রতি রাতে এই সময় আমার কাছে চলে আসবে। তোমাকে পাঁচ-ছয় রাত আসতে হবে। তার পর একদিন এজেলুনা নিজে তোমার কাছে চলে আসবে। সে পূর্বের চেয়েও অধিক মহব্বতের সাথে তোমাকে তার মনের মাঝে জায়গা করে দেবে। তুমি তার সাথে থাকতে পারবে।
সবকিছুই আমার কাছে আশ্চর্যজনক লাগছিল। আমি নিজের মাঝে এক ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। কিন্তু বুঝতে পারলাম না, এটা কিসের পরিবর্তন? আমার মনিব আমাকে সেখান থেকে নিয়ে এলো। আমি এ কথা ভেবে আশ্চর্য হচ্ছিলাম যে, এই লোক আমার প্রতি এতটা সহানুভূতিশীল হয়ে গেল কেন? সে এতটা নিঃস্বার্থ হল কীভাবে যে, আমার ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য আমাকে এই জাদুকরের কাছে নিয়ে এসেছে। আমার সন্দেহ হল, আমার প্রতি এই অনুগ্রহের বিনিময়ে সে আমার কাছে অস্বাভাবিক কিছু কামনা করবে। কিন্তু সে সহানুভূতি প্রকাশ করা ছাড়া আমার সাথে আর কোন কথাই বলল না।
পরদিন রাতে আমার মনিব আমাকে আবারও সেই জাদুকরের কাছে নিয়ে গেল। জাদুকর পূর্বের রাতের ন্যায় আমার উপর তার জাদু প্রয়োগ করল। সে আমাকে পূর্বের রাতের বাক্যগুলো বারবার উচ্চারণ করতে বলল। আমি তার বলা কথাগুলো মোহগ্রস্তের ন্যায় বলে যেতে লাগলাম–এই নারী আমার দুশমন। আমি তাকে ঘৃণা করি। সে যদি আমার সামনে আসে তাহলে আমি তাকে গলা টিপে হত্যা করে ফেলব।’
আমি এ কথাগুলো উচ্চারণ করছিলাম, আর জাদুকরের কথা অনুযায়ী রানী এজেলুনার চেহারা কল্পনা করছিলাম। এ সময় জাদুকর আমার চেহারা দুই হাত দ্বারা ধরে সামান্য উঁচু করল। সে আমাকে বলল, আমি যেন তার চোখে চোখ রাখি। আমি তার চোখের দিকে তাকানোর সাথে সাথে আমার মনে হল, আমি আমার চোখ তার চোখ থেকে পৃথক করতে পারব না। তার ঠোঁট দুটি অনবরত নড়ছিল। আমার মনে হল, তার চোখ দুটি যেন দুটি আয়না। সেই আয়নায় আমি রানী এজেলুনার চেহারা স্পষ্টরূপে দেখতে পাচ্ছি। আমার মুখ নিঃসৃত কথা আমি নিজ কানে শুনতে পারছিলাম। আমি বলছিলাম :
‘এই নারী আমার দুশমন। আমি তাকে ঘৃণা করি। সে যদি আমার সামনে আসে তাহলে আমি তাকে গলা টিপে হত্যা করে ফেলব।’
এই বাক্যগুলো আমার মনে একটি সংকল্প হিসেবে স্থান করে নিচ্ছিল। জাদুকর আজকের মত তার জাদুকর্ম এখানেই মুলতবী করল। সে আমার কপাল এবং কপালের উভয় পার্শ্ব তার আঙ্গুল দ্বারা ঘষতে ঘষতে বলল, খুব দ্রুতই তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হবে।
সে রাতে আমি আমার মনিবের সাথে ঘোড়াগাড়িতে চড়ে ফিরে আসছিলাম। পথে আমি মনিবকে বললাম, আমার বুঝে আসছে না, আমার ইচ্ছা কীভাবে পূর্ণ হবে? কেন যেন আমার মনে হচ্ছে, এজেলুনা আমার দুশমন। আমার উচিত, তাকে ঘৃণা করা। আমার মনিব হাসতে হাসতে বলল, এই জাদুকর্মের রহস্য বুঝার চেষ্টা করো না। তোমার এই বিশ্বাস রাখা উচিত যে, তোমার মনে ঘৃণার যে অনুভূতি সৃষ্টি হচ্ছে, সেটাই এজেলুনার মনে তোমার প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি করছে। মনিবের কথা শুনে আমি চুপ হয়ে গেলাম।
গতরাতে মনিব আমাকে আবারও সেই জাদুকরের নিকট নিয়ে গিয়েছিল। আমাকে অন্য একটি কামরায় নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে জাদুকরের সাথে আরও দুইজন লোক বসছিল। তারা মুচকি হেসে আমাকে স্বাগত জানাল এবং সহানুভূতি জ্ঞাপক দু-একটি কথা বলল। জাদুকর আমাকে পাশের কামরায় গিয়ে বসতে বলল। আমি পাশের কামরায় চলে গেলাম। এই কামরায়-ই আমার উপর জাদু প্রয়োগ করা হচ্ছিল। আমি উভয় কামরার দরজার মাঝখানে বসে পড়লাম।
তারা দরজা ভিড়িয়ে রেখেছিল। দরজা পুরোপুরি বন্ধ করেনি। তাদের কথা আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম। তারা হিব্রুভাষায় কথা বলছিল। হিব্রু ইহুদিদের ভাষা। তাদের ধারণা ছিল, আমি তাদের ভাষা বুঝি না। সম্ভবত এ কারণেই তারা উঁচু আওয়াজে কথা বলছিল। রানী ভাল করেই জানেন যে, আমি ইহুদিদের ভাষা বুঝি এবং বলতেও পারি।
তারা অনেক কথাই বলছিল। সবচেয়ে জরুরি কথা, যা আমি আপনাকে শুনাতে এসেছি। তাদের একজন জিজ্ঞেস করল, এই মেয়েকে দিয়ে এই কাজ করাতে পারবে? জাদুকর উত্তর, দিল, আমি এখন নিশ্চিত যে, এই মেয়েকে দিয়েই কাজ হবে। মাত্র দুইবারের আমল দ্বারাই তার মাঝে সেই প্রভাব সৃষ্টি হয়েছে, যা আমি চাচ্ছিলাম। আমার ধারণা ছিল, এই প্রভাব চতুর্থ দিন সৃষ্টি হবে।
আমার মনিব জিজ্ঞেস করল, আসল কাজ কত দিনে হবে? জাদুকর উত্তর দিল, সপ্তম বা অষ্টম দিনে। অন্যজন জিজ্ঞেস করল, এটা কীভাবে হবে?
জাদুকর বলল, যেভাবে আপনাকে প্রথমে বলেছি, সেভাবে হবে। এই মেয়ে এজেলুনার কাছে যাবে এবং তাকে গলা টিপে হত্যা করে ফেলবে।
অন্যজন জিজ্ঞেস করল, যদি ধরা পরে তাহলে বলে দেবে না যে, তুমি তার উপর জাদু প্রয়োগ করেছ?
জাদুকর বলল, তার স্বাভাবিক বিবেক-বুদ্ধি লোপ পাবে। সে কিছুই বলতে পারবে না। যাকে দেখবে, তার উপর পাখির মত আক্রমণ করবে। তখন তাকে হত্যা করে দেওয়া হবে। এ নিয়ে আপনি কোন চিন্তা করবেন না।