‘যা হওয়ার তা হয়েছে। আবদুল আযীয বললেন। এখন তাকে জিজ্ঞেস কর, সে কেন এসেছে? সে বলছে, সে তার বিশ্বস্ততা প্রমাণ করার জন্য এসেছে।
‘ঠিক আছে, বল, তুমি কি বলতে চাও।’ এজেলুনা নাদিয়াকে লক্ষ্য করে বলল। কী প্রমাণ পেশ করতে এসেছ? … বসো, ওখানেই বসো।
***
‘আমি ক্ষমা ভিক্ষা চাইতে আসেনি।’ নাদিয়া বলল। আমি এ কথা বলতেও আসিনি যে, আমাকে আপনার খেদমতের জন্য পুনরায় নিয়োগ দেওয়া হোক। আমি এটাও বলব না যে, আমি নিরপরাধ ছিলাম। আমি আপনার কৃতজ্ঞতা আদায় করব। কারণ, আপনি আমাকে শুধু খাদেমাই মনে করতেন না, বরং আমাকে আপনার বান্ধবী মনে করতেন। আপনি সবসময় আমাকে মূল্যবান কাপড় পরিয়েছেন এবং আমাকে এই অনুমতি প্রদান করেছিলেন, যেন আমি শাহজাদীদের মত সাজগোছ করে চলি। আপনি আমাকে এতটাই গুরুত্ব দিয়েছিলেন যে, মেরিডার গভর্নর রাজেলিউ আমাকে পছন্দ করতে শুরু করে। সে প্রায়ই আমাকে তার কামরায় ডেকে পাঠাত। সে আমাকে আপনার বিরুদ্ধে। গুপ্তচরবৃত্তি করতে বলেছিল, কিন্তু আমি কখনও তাকে এমন কোন কথা বলিনি, যা আপনার বিরুদ্ধে যায়। আমি আপনার সাথে প্রতারণা করতে চাইনি।’
‘এখন কি জন্য এসেছ?’ আবদুল আযীয বললেন।
‘রানী এজেলুনাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। নাদিয়া বলল। আর এ জন্য আমাকেই প্রস্তুত করা হচ্ছে। আমাকে যেভাবে প্রস্তুত করা হচ্ছে, সে কথা শুনলে আপনি অবাক হয়ে যাবেন।
‘তুমি ধীরস্থিরভাবে তোমার কথা বল।’ আবদুল আযীয বললেন। আমরা তোমার কথা শুনছি।’
‘আমি মেরিডা থেকে দূরে এক গ্রামে বসবাস করি। নাদিয়া বলল। ‘সেখানের অনেক বড় এক জমিদারের ঘরে আমি কাজ করি। তার বাচ্চাদের দেখা-শুনা করি। সেই জমিদারকে আমি বলেছিলাম, আমি রানী এজেলুনার বিশেষ খাদেমা ছিলাম। একদিন সেই জমিদার আমাকে বলল, আমার সাথে চল, আমি তোমাকে একজন জাদুকরের কাছে নিয়ে যাব। সে তোমার ভাগ্য বদলে দেবে। তুমি আবারও রাজমহলে চাকুরি করতে পারবে। আমি তার সাথে চলতে শুরু করলাম। জাদুকর সেই গ্রামেই থাকত। আমি ইতিপূর্বে তাকে সেই গ্রামে দেখিনি। অল্প কয়েক দিন হল, সে এই গ্রামে এসেছে। সে আমাকে তার সামনে বসিয়ে জিজ্ঞেস করল, আমি কী চাই? আমি তাকে বললাম, আমি রানী এজেলুনার বিশেষ খাদেমা ছিলাম। সামান্য ভুলের জন্য রানী আমাকে মহল থেকে বের করে দিয়েছেন। আমি চাই, রানী আমাকে পুনরায় তার খেদমতে বহাল করুন।
আশ্চর্যের ব্যাপার হল, আমি আমার ইচ্ছা মনের মাঝে গোপন রেখেছিলাম। ইতিপূর্বে কাউকে এ ব্যাপারে কোন কিছু বলেনি। জানি না, আমার এই জমিদার মনিব আমার প্রতি এতটা সদয় কেন হলেন যে, তিনি নিজে যেচে এসে আমাকে বললেন, এই জাদুকরের মাধ্যমে এমন জাদু করাব যে, তুমি শাহীমহলে তোমার পূর্বের মর্যাদা ফিরে পাবে। আমি আমার মনের ইচ্ছাকে এ জন্যও গোপন রেখেছিলাম যে, রানী এজেলুনা এখন আর রানী নন এবং আন্দালুসিয়ার সকল বড় বড় শহর মুসলমানদের হস্তগত হয়ে গেছে। বাদশাহ রডারিক মারা গেছে। তারপরও আমি রানী এজেলুনার কাছে আসতে চাচ্ছিলাম। আমার জমিদার মনিবের আন্তরিকতা দেখে আমি মনে মনে খুব খুশী হলাম।
জাদুকর আমার মনের ইচ্ছার কথা জিজ্ঞেস করলে আমি তার কাছে আমার মনের কথা বলে দেই। জাদুকর আমার কথা শুনে আমার কপালের দুইপাশে আস্তে আস্তে আঙ্গুল দিয়ে ঘষতে লাগল। সেই সাথে সে তার আংটি ধীরে ধীরে আমার কপালে ছোঁয়াতে লাগল। জাদুকর আমাকে বলল, তার এই জাদুর প্রভাব উল্টা হয়ে থাকে। সে যা বলবে, তার বিপরীত ফল হবে। সে আমাকে তার বলা কথাগুলো উচ্চারণ করতে বলল। সে আমাকে বলল, রানী এজেলুনার চেহারা কল্পনা কর। তুমি তার চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাক। তার কথা অনুযায়ী আমি রানীর চেহারা আমার চোখের সামনে আনলাম এবং তার চোখে চোখ রাখলাম। জাদুকর আমাকে বলল, এখন তুমি বল, এই নারী আমার দুশমন। আমি তাকে ঘৃণা করি। সে যদি আমার সামনে আসে তাহলে আমি তাকে গলা টিপে হত্যা করে ফেলব।
আমি কয়েকবার এই বাক্যগুলো বলতে লাগলাম। জাদুকর আমাকে বলল, রানী এজেলুনার চেহারা কল্পনা করে এই বাক্যগুলো এমনভাবে বলতে থাক, যেন বাস্তবেই সে তোমার দুশমন। তুমি তাকে ঘৃণা কর এবং তুমি তাকে হত্যা করতে চাও।
আমি এই বাক্যগুলো বারবার বলছিলাম, কিন্তু আমি আমার মনে রানীর প্রতি প্রকৃত ঘৃণা সৃষ্টি করতে পারছিলাম না। আমি জাদুকরকে বললাম, এটা আমার জন্য অসম্ভব। আমি আমার মনে রানীর প্রতি কিছুতেই ঘৃণা সৃষ্টি করতে পারব না। যে রানী আমাকে এত বেশি সম্মান দিয়েছেন, তাকে আমি কীভাবে আমার দুশমন মনে করতে পারি?
জাদুকর আমাকে এমন ভাব ও ভঙ্গির মাধ্যমে তার চিন্তা ব্যাখ্যা করে বুঝালো যে, এটা মূলত ঘৃণা নয়, বরং মহব্বত। আমি তার কথা মেনে নিলাম। সে আমাকে আগেই বলেছিল, তার জাদু শব্দের বিপরীত ফলাফল বয়ে আনবে।
জাদুকর পুনরায় আমার কপাল ও কপালের দুই পাৰ্শ আঙ্গুল দিয়ে ধীরে ধীরে ঘষতে শুরু করল। আমার দুই চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসছিল। হঠাৎ রানীর চেহারা আমার সামনে এমনভাবে ফুটে উঠল যে, মনে হল, এটা কল্পনা নয়; বাস্তব। বাস্তবেই রানী এজেলুনা আমার সামনে বসে আছেন। আমার মনে হল, আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। কিন্তু আমি পার্থক্য করতে পারছিলাম না যে, এটা স্বপ্ন নাকি কল্পনা? আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম যে, রানী এজেলুনা আমার সামনে ঘুরাফিরা করছেন। আমার ভিতর এই ধরনের অনুভূতি সৃষ্টি হয়ে গেছে যে, এই নারীকে আমি পছন্দ করি না। তার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।