এমনই ব্যস্ততার মাঝে যখন তাঁকে সংবাদ দেওয়া হল, সিউটার গভর্নর জুলিয়ান তার সাথে সাক্ষাৎ করতে চায়। তখন তিনি অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন। ‘জুলিয়ান! কী উদ্দেশ্যে সে আমার সাথে সাক্ষাৎ করতে চায়?
যে লোকটি জুলিয়ানের আগমনের সংবাদ নিয়ে এসেছিল সে বলল, ‘জুলিয়ান একা আসেনি, তার সাথে আরো লোকজনও আছে। তাদেরকে উচ্চপদস্ত কর্মকর্তা বা শাহীখান্দানের লোক বলে মনে হচ্ছে। তারা বেশ কিছু উপহার-উপঢৌকনও সাথে এনেছে।’
‘আল্লাহর কসম! আমার বিশ্বাস হয় না’ মুসা বিন নুসাইর বললেন। কেউ কি বিশ্বাস করবে, যাদের সাথে আমাদের লড়াই চলছে, যারা আমাদের জানের দুশমন, আচানক তারা আমাদের দোস্ত হয়ে গেছে? অসম্ভব, কিছুতেই হতে পারে না। তারা হয়তো সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। আমি তাদের সন্ধির প্রস্তাব কিছুতেই গ্রহণ করব না।’
‘মুহতারাম আমীর!’ একজন সভাসদ আরয করলেন। তারা এতটা দূর থেকে এসেছেন, তাদেরকে সাক্ষাতের সুযোগ প্রদান করা হোক।
***
সিউটা রোম সাগরের পাড়ে অবস্থিত আফ্রিকার সীমান্তবর্তী একটি ছোট্ট রাজ্য। তার বিপরীত দিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে জাবালুতারিক বা জেব্রেলটার প্রণালী। সিউটা ও জাবালুতারিকের মধ্যখান দিয়ে যে সাগর বয়ে গেছে তার বিস্তৃতি প্রায় বার মাইল।
সিউটা হল আন্দালুসিয়ার বাদশাহ রডারিকের করদ-রাজ্য। সিউটার নিজস্ব সৈন্যবাহিনী আছে। তা সত্ত্বেও রডারিক নিজের কিছু সৈন্য সেখানে মোতায়েন করে রেখেছে।
আন্দালুসিয়ার মতো শক্তিশালী রাজ্যের মদদপুষ্ট হওয়ার কারণে জুলিয়ান সর্বদা শক্তি প্রয়োগ করে আশ-পাশের অঞ্চল দখল করে নেওয়ার চেষ্টা করত। জুলিয়ানের ঔদ্ধত্য দমন করার জন্য মুসা বিন নুসাইর প্রায়ই ফৌজ প্রেরণ করতেন। জুলিয়ান বাহিনীর সাথে তাদের কয়েকবার লড়াইও হয়েছে।
মুসা বিন নুসাইর সিউটা দখল করে নেওয়ার জন্য দুই-তিনবার রীতিমত আক্রমণ পরিচালনা করেন। কিন্তু সিউটার দুর্গ এতটাই মজবুত যে, কিছুতেই তা পদানত করা সম্ভব হয়ে উঠেনি। মুসা বিন নুসাইর জুলিয়ানবাহিনীকে দুর্গের মধ্যে বন্দী করে রাখার জন্য বাবার ফৌজের মাধ্যমে দুর্গ অবরোধ করেও রাখেন।
তিনি এই ইচ্ছাও ব্যক্ত করেন যে, জুলিয়ানের অত্যাচার চিরতরে বন্ধ করার জন্য অতিসত্বর সিউটার উপর কঠিন হামলা চালাবেন। প্রয়োজন হলে দীর্ঘ দিন পর্যন্ত দুর্গ অবরোধ করে রাখবেন, যেন ক্ষুধ-পিপাসায় কাতর হয়ে দুর্গের লোকেরা অস্ত্র সমর্পণ করতে জুলিয়ানকে বাধ্য করে। তবে তিনি এই আশঙ্কাও করতেন যে, আন্দালুসিয়ার বাদশাহ বড়ারিক জুলিয়ানের সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারে। মুসা বিন নুসাইর একে একে দুইবার দূত মারফত জুলিয়ানকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। তিনি জুলিয়ানকে এই মর্মে পত্রও লেখেছিলেন যে,
‘জুলিয়ান! নিজে শান্তিতে থাকুন, অন্যকেও শান্তিতে থাকতে দিন। অন্যথায় আপনাকে ভয়াবহ পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে।’
জুলিয়ান প্রতিউত্তরে স্বৈরাচারী মনোভাব ও ঔদ্ধতের পরিচয় দিয়েছিলেন। তিনি প্রতিউত্তরে লেখেছিলেন,
‘সালতানাতে ইসলামিয়ার আমীর! সিউটা অবরোধ করার আগে আন্দালুসিয়ার ফৌজি শক্তি সম্পর্কে আপনার ধারণা থাকা উচিত। যেন পরবর্তীতে পিছু হটার লাঞ্ছনা পেতে না হয়।
মুসা বিন নুসাইর মনে মনে ভাবলেন, সেই জুলিয়ানের মতো স্বেচ্ছাচারী ও অবাধ্য দুশমন এসেছে আমার সাথে সাক্ষাৎ করতে! তিনি কিছুটা আশ্চার্য হয়ে বার্তাবাহককে ইঙ্গিত করে বললেন, ‘জুলিয়ানকে ভিতরে নিয়ে এসো।’
***
শাহীলেবাস পরিহিত জুলিয়ান রাজকীয় গাম্ভির্যের সাথে দরবারে প্রবেশ করল। সে সময় দরবারে মুসা বিন নুসাইরের সামনে দুই-তিনজন উপদেষ্টা ও কয়েকজন সালার বসাছিলেন। জুলিয়ানকে দেখে মুসা বিন নুসাইর উঠে দাঁড়ালেন। তিনি ঠোঁটের কোনে মুচকিহাসির রেখা টেনে তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন। জুলিয়ান সামনে অগ্রসর হয়ে বললেন,
‘আমি শান্তি ও নিরাপত্তার বাণী নিয়ে এসেছি, শান্তি ও নিরাপত্তার বাণী নিয়ে ফিরে যেতে চাই। দোস্তীর পয়গাম নিয়ে এসেছি, দোস্তীর সওগাত নিয়ে ফিরে যেতে চাই।’
জুলিয়ানের দোভাষী বার্বার ভাষায় জুলিয়ানের কথা তরজমা করে গুনাল।
মুসা বিন নুসাইর জুলিয়ানের সাথে কোলাকুলি করলেন। তিনি তাকে ডানবাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরে কুরসির দিকে অগ্রসর হয়ে বললেন, আমাদের ঘরে ভয়ঙ্কর কোন দুশমন এসে উপস্থিত হলে আমরা তাকে দোস্তই মনে করি। আপনার মনে যত মারাত্মক দুরভিসন্ধিই থাক না কেন, এ মুহূর্তে আমরা আপনাকে দোস্ত মনে করব।’
দোভাষী উভয়ের কথা তরজমা করে শুনাচ্ছিল।
জুলিয়ানের সাথে জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক পরিহিত চৌকস দুজন দেহরক্ষী দরবারে প্রবেশ করল। তারা উভয়ে দরজায় দু’পাশে ফলা বিশিষ্ট বল্লম উঁচিয়ে নিশ্চল পাথরের মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে রইল। তাদের দৃষ্টি ছিল সতর্ক ও অন্তর্ভেদী।
তারা উভয়ে জুলিয়ানের দিকে তাকিয়ে ছিল। জুলিয়ান মাথা নেড়ে ইঙ্গিত করল। তারা দুজন যন্ত্রচালিতের ন্যায় সম্মান প্রদর্শনের জন্য মাথা ঝুকাল। তারপর সোজা হয়ে উল্টো পায়ে দরবার থেকে বের হয়ে গেল।
তারা বের হয়ে যাওয়ার অল্প কিছুক্ষণ পরে কৃষ্ণকায় দু’জন লোক দরবারে প্রবেশ করল। তাদের মাথায় সফেদ টুপি। আর নিম্নাঙ্গে ঝলমলে রেশমী কাপরের লুঙ্গি।