আবদুল আযীয এজেলুনার রেশমের মত শরীরের উত্তাপ অনুভব করছিল। দক্ষিণা বাতাসের ঝাঁপটা এজেলুনার মসৃণ চুলকে উড়িয়ে নিয়ে বারবার আবদুল আযীযের চেহারা ঢেকে দিচ্ছিল। এজেলুনার চুলের সুগন্ধি আবদুল আযীযকে ঘোরের মধ্যে ফেলে দিল। এজেলুনার নেশা ছড়ানো ক্ষীণ আওয়াজ, আর তার প্রায় উলঙ্গ শরীরের একেকটি অঙ্গভঙ্গি আবদুল আযীযকে উন্মাদ করে দিচ্ছিল।
এজেলুনার এমন শারীরিক উত্তাপের কাছেই রডারিকের মত লৌহপ্রাণ মানুষও মোমের মত গলে যেত। সামান্য সময়ের ব্যবধানেই আবদুল আযীয একেবারে বশীভূত হয়ে গেলেন।
‘মনে রেখ, এজেলুনা কথার জাদু ছড়িয়ে অবশেষে বলল।’তোমার পিতাজি যদি তোমাকে আন্দালুসিয়ার আমীর বানাতে চান তাহলে আবার বলে বসো না যে, এটা তারিক বিন যিয়াদের হক। আমি তোমাকে আন্দালুসিয়ার সিংহাসনের উপর বসা দেখতে চাই।’
‘তুমি যা বলবে, তাই হবে, এজেলুনা!’ আবদুল আযীয নেশাগ্রস্তের মত জড়ানো আওয়াজে বললেন।
***
এক দিন এজেলুনা তার ঘরে আবদুল আযীযের কাছে বসেছিল। এ ঘরটি দেখতে মহলের মত। খ্রিস্টান গভর্নর ইতিপূর্বে এখানেই থাকত। এ সময় একজন খাদেমা ঘরে প্রবেশ করে এজেলুনাকে সংবাদ দিল, তার একজন পুরনো খাদেমা তার সাথে সাক্ষাৎ করতে চায়।
‘সে তার নাম কি বলেছে? এজেলুনা জানতে চাইল। সে বলেছে, যদি আমার নাম বলি তাহলে রানী আমাকে সাক্ষাৎ করার অনুমতি দেবেন না। সে আরও বলেছে, “রানী যদি সাক্ষাৎ করার অনুমতি না দেন তাহলে ক্ষতি তারই হবে।
‘তাকে পাঠিয়ে দাও।’ এজেলুনা বলল।
খাদেমা চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর পঁচিশ-ত্রিশ বছরের একটি দীর্ঘাঙ্গিনী যুবতী মেয়ে ঘরে প্রবেশ করল। মেয়েটি দেখতে খুবই আকর্ষণীয়। ঘরে প্রবেশ করেই সে মাথা নুইয়ে সালাম পেশ করল।
‘তুমি?’ এজেলুনা ভর্ৎসনার সুরে বলল। নাদিয়া। তুমি কি মনে করেছ, আমি তোমাকে মাফ করে দিয়েছি? তুমি খাদেমাকে এ কথা কেন বললে যে, আমি যদি তোমাকে সাক্ষাতের অনুমতি না দেই তাহলে আমারই ক্ষতি হবে। আমার কী ক্ষতি হবে?
‘আমি ক্ষমা চাওয়ার জন্য আসিনি, রানী! নাদিয়া বলল। আমি আমার বিশ্বস্ততার পরিচয় দিতে এসেছি। যদি আপনি আমাকে কথা বলার অনুমতি দেন। তাহলে আমি বলতে পারি।’
‘তার অপরাধ কি? এজেলুনা!’ আবদুল আযীয জিজ্ঞেস করলেন।
‘শাহ রডারিক যখন গোয়াডিলেট নদীর অভিমুখে রওনা হচ্ছিলেন তখন আমি এই মেরিডা চলে এসেছিলাম।’ এজেলুনা বলল। শাহ রডারিকের পরাজয় ও নিহত হওয়ার সংবাদ এখানে পৌঁছলে রাজেলিউ আমাকে পাওয়ার জন্য উন্মাদ হয়ে উঠে। সে এতটাই আবেগ প্রবণ হয়ে আমার সামনে তার ভালোবাসা প্রকাশ করে যে, আমি তার ভালোবাসা গ্রহণ করতে বাধ্য হই। কিন্তু আমি তাকে বলি, আগে মেরিডাকে মুসলমানদের হাত থেকে বাঁচাও, এই শহরকে রাজধানী বানাও এবং আন্দালুসিয়া থেকে মুসলমানদেরকে বের করে দাও, তাহলেই আমি তোমার হব…।
রাজেলিউ এই শহরকে বাঁচানোর জন্য জান-প্রাণ দিয়ে চেষ্টা করে। আমি নিজেও সেনাবাহিনী এবং শহরের অধিবাসীদেরকে লড়াই করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছি। এ সময় নাদিয়া আমার একান্ত খাদেমা ছিল। আমি তাকে আমার মনের কথা বলার সাথী বানিয়ে নিয়েছিলাম। এক রাতে আমি শহরের নেত্রিস্থানীয় লোকদেরকে একতিত্র করে দিকনির্দেশনা দিচ্ছিলাম, কীভাবে জনসাধারণকে এবং নারীদেরকে লড়াই করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে। এই আলোচনায় রাজেলিউ উপস্থিত ছিল না। সে অযুহাত দেখাল, তার পিঠে প্রচণ্ড ব্যথা করছে।
আমি আলোচনা শেষ করে রাজেলিউর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার জন্য তার কামরার দিকে রওনা হলাম। পথিমধ্যে অন্য একজন খাদেমা আমাকে বলল, নাদিয়া অনেকক্ষণ হয় রাজেলিউর কামরায় আছে। সে আমাকে আরও বলেছে, সে চিলেকোঠার ছিদ্রপথে উভয়কে বিশেষ অবস্থায় দেখেছে। চিলেকোঠা থেকে নেমে এসে খাদেমা একটি জানালার সাথে কান লাগিয়ে তাদের সব কথা শুনেছে। নেশার ঘোরে তারা এতটাই উঁচু আওয়াজে কথা বলছিল যে, তাদের কথা বাইরে থেকে স্পষ্ট শুনা যাচ্ছিল। খাদেমা আমাকে বলেছে, তাদের কথা থেকে বুঝা যাচ্ছিল, রাজেলিউ গুপ্তচরবৃত্তির জন্য নাদিয়াকে আমার পিছনে লাগিয়ে রেখেছে। নাদিয়ার মাধ্যমে সে জানতে পারত, আমি কোন কোন জেনারেলের সাথে দেখা করি এবং কারও সাথে আমার বিশেষ কোন সম্পর্ক আছে কি না?
খাদেমার কথা শুনে আমি আমার কামরায় চলে আসি। কিছুক্ষণ পর নাদিয়া আমার কামরায় আসে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, কোথায় ছিলে? সে আমার সাথে মিথ্যা কথা বলে। আমি লক্ষ্য করি সে তখনও নেশার ঘোরে ছিল। আমি তাকে শুধু এতটুকু বলি যে, এই মুহূর্তে এখান থেকে বের হয়ে যাও। আর কখনই যেন তোমাকে এই শহরে না দেখি। সে চলে যাওয়ার সময় বলে যে, রাজেলিউর তাকে জোর করে তার কামরায় নিয়ে গেছে এবং তাকে হত্যা করার ভয় দেখিয়ে মদ পান করিয়ে তার সাথে…।
‘শাহী খান্দানে এটাতে কোন আপত্তিকর বিষয় নয়?’ আবদুল আযীয বললেন। সে যদি রাজেলিউর কথা না শুনত তাহলে তো রাজেলিউ তাকে হত্যা করে ফেলত। তুমি রাজেলিউকে কিছু বলোনি?
‘না।’ এজেলুনা বলল। আমি তাকে বুঝতেই দেইনি যে, আমি বিষয়টি জানি। নাদিয়াকে বের করে দিয়ে আমার কোন আফসোস হয়নি। আমাকে আরও অনেকেই বলেছে, খাদেমা হিসেবে নাদিয়া উপযুক্ত হলেও, সে ছিল রাজেলিউর হাতের পুতুল।’