‘শুধু তাই নয়, বৎস! মুসা বললেন। রোম ও পারস্যের পরাশক্তিকে গুঁড়িয়ে দিয়ে ইসলামী সালতানাতের সীমানা বহুদূর পর্যন্ত সম্প্রসারিত করেছিলেন তিনি। মামুলি একটি হুকুম অমান্য করার কারণে হযরত ওমর রাযি. তাকে সিপাহসালারের পদ থেকে অপসারিত করেন। ইসলাম ধর্ম খলীফা, আমীর, ইমাম ও যিম্মাদারের আদেশ অমান্য করাকে বরদাশত করে না, যদি সেই আদেশ আল্লাহ তাআলার হুকুমের বিরোধী না হয়।’
‘আপনি তারিক বিন যিয়াদকে শস্তি দিতে পারেন। আবদুল আযীয বললেন। কিন্তু তাকে তার এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারেন না যে, সেই আন্দালুসিয়ার প্রথম আমীর হওয়ার যোগ্য।’
‘প্রিয়, মহামান্য আমীরের সাথে তর্ক করা আপনার জন্য সমীচীন নয়। এজেলুনা হঠাৎ আবদুল আযীয়কে লক্ষ্য করে বলে উঠল। সে এতক্ষণ পিতা-পুত্রের কথাবার্তা শুনছিল।
‘আপনার পিতা হলেন সর্বাধিনায়ক। কাকে আন্দালুসিয়ার আমীর নিযুক্ত করা হবে, সে দায়িত্ব তার। তিনি আপনার চেয়ে অনেক বেশি অভিজ্ঞ। তিনি যাকে যোগ্য মনে করবেন, তাকেই আন্দালুসিয়ার আমীর নিযুক্ত করবেন। তারিক বিন যিয়াদ আন্দালুসিয়ার বিজয়ী হতে পারেন। হতে পারেন, অনেক বড় একজন সিপাহসালার। বাস্তবেও তিনি অনেক বড় মাপের একজন সিপাহসালার। রডারিককে পরাজিত করা মামুলি কোন ব্যাপার নয়। কিন্তু কোন রাজ্যের আমীর হওয়ার জন্য যেসকল গুণাবলী আর যোগ্যতার প্রয়োজন, সেগুলো তারিক বিন রিয়াদের মাঝে নেই। সেগুলো একমাত্র আপনার মাঝেই বিদ্যমান আছে।
‘আমার মাঝে!?’ আবদুল আযীয আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
‘হ্যাঁ, প্রিয়তম!’ এজেলুনা বলল। আপনার মাঝেই আন্দালুসিয়ার আমীর হওয়ার যোগ্যতা আছে। আপনি এক মহান পিতার সন্তান। এমন মহানুভব পিতার তো খলীফা হওয়া উচিত। তিনি তাঁর ব্যক্তিত্ব ও মহত্ত্ব অনুযায়ী আপনাকে প্রতিপালিত করেছেন। আমি স্বীকার করছি, ইসলাম সমতা বিধানের নির্দেশ দেয়। ইসলামে গোলাম আর মনিবের মাঝে কোন পার্থক্য নেই। কিন্তু যে ব্যক্তি গোলামির শৃঙ্খল পায়ে জড়িয়ে বড় হয়েছে, তাকে যদি আপনি মুক্তও করে দেন এবং তাকে মাথার উপর বসিয়ে দেন, তাহলে সে হয়তো আপনার জন্য জীবন উৎসর্গ করে দেবে, কিন্তু কোন দিন মনিব হতে পারবে না। মনিব হওয়ার সকল গুণাবলী থেকে সে চিরকাল বঞ্চিত থাকবে।’
এজেলুনা সুরের মুর্ছনা ছড়িয়ে কথা বলে যাচ্ছিল। আর মুসা বিন নুসাইর তন্ময় হয়ে তার কথা শুনছিলেন। এজেলুনা এমনিতেই অত্যন্ত রূপসী ছিল। তার উপর তার কথা বলার ভঙ্গি এতটাই হৃদয়গ্রাহী আর আকর্ষণীয় ছিল যে, মনে হত-তার মুখ থেকে বের হওয়া প্রতিটি শব্দ শ্রোতার হৃদয়ে সুরের ঝঙ্কার তুলছে।
মুসা বিন নুসাইর বয়োঃবৃদ্ধ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন। তিনি গভীর দৃষ্টিতে এজেলুনার দিকে তাকিয়ে রইলেন। মনে হচ্ছিল, তিনি এই সুশ্রী চেহারার রহস্য উদাটনের চেষ্টা করছিলেন।
আবদুল আযীয নওজোয়ান ছিলেন। এজেলুনার রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে বিবাহ করেছিলেন। তিনি এই পূর্ণযৌবনা নারীর হাতে মনঃপ্রাণ সপে দিয়েছিলাম। তার উপর বিদ্রোহীদেরকে ধ্বংস করে এজেলুনা আবদুল আযীযের অন্তরে এক ধরনের শ্রদ্ধার আসন গড়ে নিয়েছিল। আর এ জন্যই এজেলুনার আন্তরিকতা মিশ্রিত ও জোরালো বক্তব্যের সামনে আবদুল আযীয কোন কথা খুঁজে পেলেন না।
রাত গম্ভীর হয়ে এসেছিল। মুসা বিন নুসাইর তার শয়নগৃহে চলে গেলেন। আবদুল আযীয এজেলুনাকে নিয়ে তাদের শয়নগৃহের দিকে রওনা হলেন। এজেলুনার কথার কোন উত্তর দিতে না পেরে আব্দুল আযীয মনে মনে কিছুটা অস্বস্তি অনুভব করছিলেন। কামরায় প্রবেশ করেই আবদুল আযীয এজেলুনাকে বুকের উপর টেনে নিয়ে বললেন,
‘প্রিয়তমা, আমি তারিক বিন যিয়াদের বিরুদ্ধে কোন কথাই বরদাশত করতে পারি না। তুমি তাকে এখনও গোলাম মনে কর? তুমি আমাকে তার চেয়েও শ্রেষ্ঠ মনে কর? আমি লক্ষ্য করছি, আরব আর বার্বারদের দুটি ভিন্ন সম্প্রদায় কোন দিকে চলছে। আরবরা নিজেদেরকে বার্বারদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও অধিক সম্মানের অধিকারী মনে করে। বাস্তবতা হল, যে ইসলাম গ্রহণ করে নিয়েছে, তার অন্তর থেকে উঁচু-নীচুর ভেদাভেদ দূর হয়ে গেছে। আল্লাহর দৃষ্টিতে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী সেই, যে আল্লাহকে বেশি ভয় করে।’
এজেলুনা শুধু রূপসীই ছিল না, বরং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছলনাময়ী নারীরাও তার কাছে খেলার পাত্রী ছিল। তার মুখের কথায় জাদুর প্রভাব ছিল। সে ভাল করেই জানত, কোন সময় কোন ধরনের অভিনয়ের প্রয়োজন হয়। এজেলুনা দেখতে পেল, আবদুল আযীয তারিক বিন যিয়াদের বিরুদ্ধে কোন কথা শুনতে প্রস্তুত নয়। তাই সে তার চাল পাল্টে দিল। প্রকৃত অর্থে এজেলুনা মন থেকেই চাচ্ছিল যে, আন্দালুসিয়ার প্রথম আমীর হবে তার স্বামী আবদুল আযীয। আবদুল আযীয নিজেও বিয়ের সময় এজেলুনাকে এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সে কোন সাধারণ ঘরণী হবে না, রাজরানী হবে।
‘আমি অন্তর থেকে তারিক বিন যিয়াদের বিরোধী নই, প্রিয়! এজেলুনা আবদুল আযীযকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে বলল। আমি তাকে ততটাই সম্মান করি, যতটা তুমি কর। তোমার সামনে তার কোন প্রশংসা করতে আমি ভয় করি। হয়তো তুমি সন্দেহ করবে, তোমার চেয়েও তারিক বিন যিয়াদ আমার কাছে বেশি প্রিয়। আমি তারিক বিন যিয়াদকে নীচু শ্রেণীর মানুষ মনে করি না।’