এজেলুনা অতিঅল্প সময়ের মধ্যে যে কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছে, সে জন্য আমীর মুসা বিন নুসাইরের পক্ষ থেকে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা আবশ্যক ছিল। কিন্তু মুসা বিন নুসাইর এই রূপসী নারীর প্রতি এতটাই প্রভাবিত হয়ে পড়েছিলেন যে, তিনি এদিকে খেয়ালই করেননি, এই নারী তার পুত্রবধূ হওয়া সত্ত্বেও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার ব্যাপারে এতটা অনাগ্রহী কেন? অদূর ভবিষ্যতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার কোন আগ্রহ তার মাঝে নেই কেন?
‘তারিক বিন যিয়াদকেও সতর্ক করে দেওয়া উচিত।’ আবদুল আযীয মুসা বিন নুসাইরকে বললেন। সে এখনও ইহুদিদেরকে তার বন্ধু এবং সমর্থক মনে করছে। সে এখন একা, ইহুদিদের ধোঁকায় পড়ে যেতে পারে।’
‘তারিক বিন যিয়াদকে আমি আর কী সতর্ক করব?’ মুসা বিন নুসাইর রাগতস্বরে বললেন। ও একটা অবাধ্য, নাফরমান। ধোঁকার শিকার হয়ে যখন সব কিছু হারাবে তখন বুঝতে পারবে। আমি তার কাছে সংবাদ পাঠিয়ে ছিলাম, সে যেখানে আছে সেখানেই যেন অবস্থান করে। কিন্তু সে আমার হুকুমের কোন পরোয়া করেনি। গতরাতে আমি সংবাদ পেয়েছি, সে টলেডু থেকে বের হয়ে এমন এক পাহাড়ী এলাকার দিকে অগ্রসর হয়ে পড়েছে, যা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর ও বিপদজ্জনক।
‘টলেডু থেকে কেউ কি এসেছে? আবদুল আযীয জিজ্ঞেস করলেন।
‘আমি কাসেদ পাঠিয়েছিলাম।’ মুসা বিন নুসাইর মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে বললেন। ‘আমি তার কাছে সংবাদ পাঠিয়ে ছিলাম, সে যেন টলেডুতে অবস্থান করে আমার আগমনের অপেক্ষা করে। আমি যে কোন সময় টলেডু এসে উপস্থিত হব। গতরাতে কাসেদ ফিরে এসেছে। সে বলেছে, আরও তিন দিন আগেই তারিক বিন যিয়াদ টলেড় থেকে বের হয়ে গেছে। টলেডু পৌঁছে কাসেদ জানতে পেরেছে, তারিক বিন যিয়াদ যে রাস্তা অবলম্বন করেছে, তা অত্যন্ত ভয়াবহ আর বিপদজ্জনক। জুলিয়ান আর আউপাস তারিক বিন যিয়াদকে বাধা দিয়েছিল। কিন্তু সে কারও কোন কথাই শুনেনি। এখন আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তার কাছে পয়গাম পাঠাব, সে যেন টলেডু এসে আমার সাথে সাক্ষাত করে।
‘আপনি কোথায় পয়গাম পাঠাবেন।’ আবদুল আযীয বললেন। কাসেদ তারিক বিন যিয়াদকে কোথায় পাবে?’
‘তারিক বিন যিয়াদ যে জলাভূমির দিকে রওনা হয়েছে, তা পার হয়ে এলে মায়েদা নামে একটি শহর পড়ে। মুসা বিন নুসাইর বললেন।
‘গ্লাশিয়া ও তালবিরা নামক শহর দুটিও সে পথেই পড়ে।’ এজেলুনা মুসা বিন নুসাইরের কথার মাঝে বলে উঠল। সেই ভয়ঙ্কর পাহাড়ী জলাভূমির পর এ রকম তিন-চারটি বড় শহর আছে। শাহ রডারিকের সাথে আমি তিন-চারবার সেসব এলাকা সফর করেছি। সেখানে আমরা সিংহ শিকার করেছি। একবার সেখান থেকে আমরা একটি কুমির ধরে এনছিলাম। অত্যন্ত ভয়ঙ্কর এক জলাভূমি এটি। নিরাপদ রাস্তা এই জলাভূমির বাহির দিয়ে গেছে।’
‘কাসেদ নিরাপদ রাস্তা দিয়ে যাবে।’ মুসা বিন নুসাইর বললেন। ‘তারিক বিন যিয়াদের একবার আমার সামনে আসা দরকার। আমি তার লাগাম টেনে ধরতে চাই।’
‘সম্মানিত পিতা!’ আবদুল আযীয মুসা বিন নুসাইরকে ক্রোধান্বিত দেখে বললেন। তারিক বিন যিয়াদকে তিরস্কার করার সময় এ কথা আপনাকে মনে রাখতে হবে যে, সে আন্দালুসিয়ার সর্বপ্রথম বিজেতা হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। এটা সুনিশ্চিত যে, আন্দালসিয়ার প্রথম আমীর তারিক বিন যিয়াদই হবে।’
‘আমি তারিক বিন যিয়াদকেই আন্দালুসিয়ার সর্বপ্রথম বিজেতা মনে করি। মুসা বিন নুসাইর বললেন। কিন্তু তার মত একজন অবাধ্য ও একরোখা লোককে এই রাজ্যের আমীর নিযুক্ত করতে পারি না। সে এই রাজ্য জয় করেছে ঠিক; কিত বিজয়ের পর পরই তার বিজীত সকল এলাকায় বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠেছে।
‘সম্মানিত পিতা! আপনি এমন ধারণা পোষণ করছেন না তো যে, তারিক বিন যিয়াদ আপনার গোলম ছিল।’ আবদুল আযীয বললেন। ‘আমার সন্দেহ হচ্ছে, আপনার এমন ধারণাই তারিক বিন যিয়াদের প্রতি আপনার মনকে বিষিয়ে তুলছে।’
‘না প্রিয় পুত্র আমার। মুসা বিন নুসাইর বললেন। আজাদকৃত গোলামকে তুচ্ছ মনে করা ইসলামী বিধানের পরিপন্থী। আমি আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়সাল্লামের কোন নির্দেশ অমান্য করার দুঃসাহস করতে পারি না। আমি প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর রাযি.-এর ইন্তেকালের কিছু দিন পূর্বে জন্ম গ্রহণ করেছি। আমি হযরত ওমর রাযি.-এর খেলাফতের যুগ দেখেছি। স্বপ্নের মত সে যুগের কথা আমার মনে আছে। সে সময় আমি খুব ছোট ছিলাম। আমি এই মহান খলীফার পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলতে চাই। তুমি নিশ্চয় শুনেছ যে, হযরত খালিদ বিন ওলিদ রাযি.-কে দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর রাযি. সিপাহসালারের পদ থেকে অপসারণ করেছিলেন। তুমি কি জান, খালেদ বিন ওলিদ কত বড় সিপাহসালার ছিলেন?
‘জানি, সম্মানিত পিতা!’ আবদুল আযীয বললেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খালেদ বিন ওলিদ রাযি.-কে আল্লাহর তরবারী উপাধি দিয়েছিলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের পরপরই ধর্ম ত্যাগের ফেতনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। ইসলামের বিরুদ্ধে সেটা ছিল সুসংগঠিত বিশাল এক ফেতনা। দূরদূরান্ত পর্যন্ত সেই ফেতনার প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল। খালেদ বিন ওলিদ রাযি. ইসলাম-দ্রোহী এই ফেতনার মূলোৎপাটন করেছিলেন।