‘আমি রক্তপাত পছন্দ করি না।’ দুর্গরক্ষক বলল। আমি এ কথা স্বীকার করছি, যে ব্যক্তি জলাভূমি অতিক্রম করে আসতে পারে, তার পক্ষে কোন কিছুই অসম্ভব নয়। আমরা সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে এসেছি।’
‘ঠিক আছে, তোমাদের প্রস্তাব আগে শুনি। তারিক বিন যিয়াদ বললেন।
‘আমরা প্রত্যেক নাগরিকের জান-মাল ও ইজ্জত-আবরুর জামানাত চাই। দুরক্ষক বলল। আমরা চাই, কোন নাগরিকের ঘর যেন লুণ্ঠন করা না হয়।’
‘এটা তোমাদের শর্ত নয়। তারিক বিন যিয়াদ বললেন। এটা সেই মহান ধর্মের শর্ত যে ধর্ম আমরা সাথে করে নিয়ে এসেছি। আমরা এখানে লুটতরাজ করতে এবং অসহায় মানুষের ইজ্জত লুণ্ঠন করতে আসিনি। আমরা মানুষের সে সম্মান ফিরিয়ে দিতে এসেছি, যে সম্মান আল্লাহ মানুষকে প্রদান করেছেন। তোমরা নিশ্চিন্ত মনে শহরে গিয়ে শহরের ফটক খুলে দিতে পার।
কোন রকম রক্তপাত ছাড়াই তারিক বিন যিয়াদ মায়েদা দখল করে নেন। মায়েদার প্রশাসনিক দায়-দায়িত্ব পালন করার জন্য লোক নিয়োগ করে তারিক বিন যিয়াদ গ্ল্যাশিয়া অভিমুখে রওনা হন। গ্লাশিয়া মায়েদার চেয়ে ছোট্ট একটি শহর। মামুলি বাধা অতিক্রম করে তারিক বিন যিয়াদ এই শহরটি দখল করে নেন। গ্ল্যাশিয়ার মত তালবিরা নামক অন্য একটি শহরও অতি সহজে মুসলিম বাহিনীর হাতে বিজিত হয়।
এটা ৭১৪ খ্রিস্টাব্দের ঘটনা। তালবিরা জয় করার পর তারিক বিন যিয়াদ তার বাহিনীকে দীর্ঘ বিশ্রামের সুযোগ প্রদান করেন।
মুসলিম ঐতিহাসিক ইবনুল কওতিয়া লেখেন, তারিক বিন যিয়াদ লৌহকঠিন মনোভাবের অধিকারী এবং বাস্তবধর্মী একজন সিপাহসালার ছিলেন। কিন্তু মাঝে মধ্যে তার উপর শিশুসুলভ চপলতা ও সরলতা ভয় করত। তিনি তখন ঘোট ছোট বাচ্চাদের মত আচরণ করতেন। একদিনের ঘটনা। তিনি তার জেনারেলদেরকে ডেকে হাসতে হাসতে বললেন, যেসব গনিমতের মাল আমরা অর্জন করেছি, সেগুলো আমার সামনে উপস্থিত কর। নির্দেশ অনুযায়ী গনিমতের মূল্যবান বস্তুসামগ্রী কয়েকটি খচ্চরের উপর বোঝাই করে নিয়ে আসা হল। গনিমতের এসব সামগ্রী অত্যন্ত মূল্যবান ছিল। এগুলোর মধ্যে একটি টেবিল ছিল সবচেয়ে মূল্যবান। বলা হয়, এটি ছিল হযরত সুলায়মান আলাইহিসসালামের টেবিল।
‘এটি আমি আমিরুল মুমিনীন ওলিদ বিন আবদুল মালেকের খেদমতে পেশ করব। তারিক বিন যিয়াদ ছোট বাচ্চাদের মত আনন্দের সাথে বলে উঠলেন।
‘আমিরুল মুমিনীনের জন্য সবচেয়ে উত্তম উপহার তো আন্দালুসিয়াই। একজন সালার বললেন।
‘আন্দালুসিয়াকে তো আমি আল্লাহ তাআলার খেদমতে পেশ করে দিয়েছি। তারিক বিন যিয়াদ বললেন। এই রাজ্য আল্লাহর রাসূলের জন্য। কে জানে, কখন দুশমনের কোন তীর আমাকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নিকট পৌঁছে দেয়। তাই আমি আগেই আমর উপহার আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নিকট পৌঁছে দিয়েছি।
স্বর্ণ-রূপার তৈরী এসকল বস্তুসামগ্রী আর হিরা-মতি-পান্নার মত মহামূল্যবান পাথর হল, দুনিয়াদারদের জন্য। জীবিত লোকদের জন্য।
পরক্ষণেই তারিক বিন যিয়াদ আবেগ থেকে বের হয়ে শিশুদের মত প্রতিটি বস্তুকে পৃথক পৃথক করে রাখতে শুরু করলেন। তিনি প্রতিটি বস্তু পৃথক পৃথক করে রাখছিলেন, আর বলছিলেন, এটা মুসা বিন নুসাইরের জন্য। এটা আমি আমীরুল মুমিনীনকে দেব…।’
তারিক বিন যিয়াদের জানাই ছিল না যে, আন্দালুসিয়ার যেসকল এলাকা তিনি জয় করে এসেছিলেন, সেগুলোতে কী ভয়াবহ বিশৃংখলা ছড়িয়ে পড়েছে। বড় বড় প্রায় সকল শহরেই বিদ্রোহের দাবানল ছড়িয়ে পড়েছিল। অপর দিকে তারিক বিন যিয়াদ তার বানিহীকে ভয়ঙ্কর এক জলাভূমিতে প্রবেশ করিয়ে তাদেরকে জীবন-মৃত্যুর সম্মুখীন করে দিয়ে ছিলেন। আল্লাহ তাআলার বিশেষ অনুগ্রহে উভয় বিপদই কেটে গিয়েছিল।
***
তারিক বিন যিয়াদের বাহিনী যখন তালবিয়ায় বিশ্রাম করছিল সেই সময় আবদুল আযীয মুসা বিন নুসাইরের নিকট মেরিডার রিপোর্ট পেশ করছিলেন। তিনি কীভাবে বিদ্রোহ দমন করেছেন এবং কতজন বিদ্রোহী নেতাকে হত্যা করেছেন, সে ব্যাপারে বিস্তারিত জানাচ্ছিলেন। এ সময় তার স্ত্রী এজেলুনা তার সাথেই ছিল।
‘বিদ্রোহ দমনের সব কৃতিত্ব এজেলুনার।’ আবদুল আযীয মুসা বিন নুসাইরকে বললেন, এজেলুনা কীভাবে বিদ্রোহ নেতাদেরকে এক স্থানে একত্রি করেছিল। যদি এজেলুনা আমাদেরকে সহযোগিতা না করত তাহলে তখনই আমরা বিদ্রোহীদের সম্পর্কে জানতে পারতাম যখন বিদ্রোহীরা বড় শহরগুলোর উপর নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হত। আর তখন বিদ্রোহ দমন করা কোনভাবেই সম্ভব হত না।
‘আপনি হয়তো বুঝতে পেরেছেন, আমি কেন আমার ধর্ম ত্যাগ করেনি? এজেলুনা বলল। আমি যদি মুসলমান হয়ে যেতাম তাহলে আমি কিছুই করতে পারতাম না। আমি একজন খ্রিস্টান এবং রডারিকের বিধবা স্ত্রী হওয়ার কারণে তারা সকলেই আমার জালে ধরা দিয়েছিল। আমি আবারও বলছি, আমাকে আমার ধর্ম ত্যাগ করতে বলবেন না। সবচেয়ে গুত্বপূর্ণ বিষয় হল, ইহুদিদেরকে মোটেই বিশ্বাস করা যাবে না। তারা প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে তারিক বিন যিয়াদকে যতই সহযোগিতা করুক না কেন, মূলত তারা নিজেদের স্বার্থের জন্যই এই সহযোগিতা করছে। তারা বাদশাহ রডারিকের সিংহাসন উল্টে দিতে চেয়েছিল। কারণ, শাহ রডারিক ইহুদিদেরকে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী সম্প্রদায় এবং শয়তানের গোষ্ঠী মনে করত। তার রডারিককে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছে। এখন তারা চেষ্টা করছে, যেন আপনাদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা লাভ করতে না পারে।