তারিক বিন যিয়াদ তার বাহিনীকে এই উপত্যকায় যাত্রা বিরতি করার নির্দেশ দিলেন। উপত্যকাটি ছিল সবুজ-শ্যামল। ঘোড়া ও খচরগুলোকে লাগামমুক্ত করে দেওয়া হল। মুজাহিদগণের অবস্থা এমন হয়ে গিয়েছিল যে, তারা প্রশস্ত জায়গা পেয়ে মাটিতে শুয়ে পড়লেন। যে যেখানে বসেছিলেন, সেখানেই ঘুমিয়ে পড়লেন।
***
তারিক বিন যিয়াদের নির্দেশে মুজাহিদ বাহিনী দুই দিন এই উপত্যকায় অবস্থান গ্রহণ করল। দুই দিন বিশ্রাম নেওয়ার পর মুজাহিদ বাহিনী নতুন উদ্যমে সামনে চলতে শুরু করল। মুজাহিদ বাহিনী যেসব এলাকা অতিক্রম করছিল, সেগুলো সমতল ছিল না ঠিক; কিন্তু পূর্বের এলাকাগুলোর মত তেমন দুর্গমও ছিল না। মুজাহিদ বাহিনী অনেকটা নির্ভয়ে পথ চলছিল।
সামনের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার জন্য ছোট ছোট কয়েকটি দল আগে আগে পথ চলছিল। তাদের দু-একটি দল পিছিয়ে এসে তারিক বিন যিয়াদকে সংবাদ দিল, আর মাত্র এক দিনের পথ অতিক্রম করলেই আমরা একটি শহরে পৌঁছতে পারব। শহরের নাম মায়েদা।
সংবাদ পেয়ে তারিক বিন যিয়াদ গোটা বাহিনীকে সেখানেই অবস্থান করার নির্দেশ দিলেন, যাতে পূর্ণ একদিন বিশ্রাম নিয়ে নতুন উদ্যমে মুজাহিদ বাহিনী শহরে প্রবেশ করতে পারে।
যে রাস্তা অবলম্বন করে তারিক বিন যিয়াদ এই লোমহর্ষক অভিযান পরিচালনা করছিলেন ইতিহাসে সেই রাস্তাটি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ বলে সাব্যস্ত হয়েছিল যে, পরবর্তীতে ‘তারিক সরণি’ নামে পরিচিত লাভ করে। আজ শত শত বছর পরও মানুষ সেই রাস্তাটিকে ‘তারিক সরণি’ নামেই চিনে।
মাত্র একদিনের দূরত্বে তারিক বিন যিয়াদের বাহিনী বিশ্রাম করছিল। মায়েদার অধিবাসীরা মুসলিম বাহিনীর আগমন সম্পর্কে পূর্বেই জানতে পেরেছিল। এত দ্রুত আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা তাদের ছিল না। তার পরও তারা প্রস্তুত হয়েই ছিল। দুর্গের ফটক বন্ধ করে মায়েদার সিপাহীরা দুর্গ প্রাচীরের উপর ওঁতপেতে রইল। মুসলিম বাহিনী ফটক বন্ধ দেখে দুর্গ অবরোধ করল।
আন্দালুসিয়ার বড় বড় শহরের মধ্যে মায়েদাও একটি। ভূ-রাজনৈতিক ও অনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে মায়েদার গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি।
শহর রক্ষা প্রাচীরের উপর সিপাহীরা তীর-ধনুক আর বর্শা-বল্লম নিয়ে প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তারা মুসলিম বাহিনীকে লক্ষ্য করে হুঙ্কার দিচ্ছিল। তাদের হম্বিতম্বি দেখে মনে হচ্ছিল, তারা মায়েদার জন্য জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত হয়ে আছে। তারিক বিন যিয়াদ ঘোড়ায় চড়ে শহরের চতুর্দিকে চকর লাগালেন। দুর্গের দেয়াল তাঁর কাছে খুবই মজবুত মনে হল। জনসাধারণ আর সিপাহীদের মনোভাব দেখে মনে হল, তাদের মনোবল শহর রক্ষা-প্রাচীরের মতই মজবুত।
তারিক বিন যিয়াদ স্থানীয় ভাষায় ঘোষণা করালেন, “তোমাদের জন্য উত্তম হল, দুর্গের ফটক খুলে দেওয়া। তোমরা যদি ফটক খুলে দাও তাহলে আমরা তোমাদেরকে দোস্ত মনে করব। তোমাদের থেকে কোন রকম টেক্স বা জরিমানা নেওয়া হবে না। আর যদি শক্তি প্রয়োগ করে আমাদেরকে ফটক খুলতে হয় তাহলে তোমাদের সাথে এমন আচরণ করা হবে, যেমন দুশমন দুশমনের সাথে করে থাকে।
তারিক বিন যিয়াদের ঘোষণার জবাবে দুর্গ প্রাচীরের উপর থেকে তীর বৃষ্টি শুরু হল। সেই সাথে হুঙ্কার ভেসে এলো–হিম্মত থাকলে নিজেরাই ফটক খুলে নাও।’
অগত্যা তারিক বিন যিয়াদ ফটকের উপর আক্রমণ করার নির্দেশ দিলেন। সারাদিন সমান তালে ফটকের উপর হামলা করা হল, কিন্তু দিন শেষে আশানুরূপ কোন ফলাফল দৃষ্টিগোচর হল না।
***
পরদিন সকালে গত দিনের মত হত্যাযজ্ঞ শুরু হওয়ার প্রস্তুতি চলছিল। এমন সময় দুর্গের প্রধান ফটক খুলে গেল। চারজন অশ্বারোহী দুর্গ থেকে বের হয়ে এলো। একজন অশ্বারোহীর হাতে আছে সফেদ ঝাণ্ডা। অশ্বারোহী দলটি মুসলিম বাহিনীর কাছে এসে বলল, তোমাদের সিপাহসালার কোথায়? আমরা সন্ধির জন্য কথা বলতে এসেছি।
তাদেরকে তারিক বিন যিয়াদের নিকট পৌঁছে দেওয়া হল। সন্ধির জন্য দুর্গরক্ষক স্বয়ং এসেছিল।
‘সিপাহসালার!’ দুর্গরক্ষক বলল। এটা কি সত্য কথা যে, আপনি আপনার বাহিনীকে নিয়ে জলাভূমি অতিক্রম করে এখানে এসেছেন?
‘কেন?’ তারিক বিন যিয়াদ মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলেন। ‘তুমি কি এ কথা শুনে অবাক হচ্ছ যে, আমি জলাভূমি অতিক্রম করে এসেছি?
‘হা…।’ দুর্গরক্ষক বলল। শুধু আমি নই, যেই এ কথা শুনবে, সেই অবাক হবে। এই জলাভূমি একমাত্র সেই অতিক্রম করতে পারে, যে জিন সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত বা কারও প্রেতাত্মা। কোন মানুষের পক্ষে সুস্থ অবস্থায় জীবন নিয়ে এই জলাভূমি অতিক্রম করা সম্ভব নয়। কয়েক মাসের পথের দূরত্ব অতিক্রম করতে আমরা রাজি আছি, কিন্তু এই জলাভূমি অতিক্রম করতে রাজি নই।’
‘চোখ খুলে দেখে নাও বন্ধু!’ তারিক বিন যিয়াদ দৃপ্তকণ্ঠে বললেন। আমি ও আমার বাহিনী সুস্থ ও জীবিত তোমার সামনে উপস্থিত। ভেবে দেখ, যে ব্যক্তি তার বাহিনীকে জিন ও প্রেতাত্মাদের জলাভূমি থেকে জীবিত বের করে আনতে পেরেছে, তার জন্য এ শহরের ফটক খোল তেমন কঠিন কোন কাজ নয়। মানুষের রক্তপাত যদি তোমার কাছে কাক্ষিত বিষয় হয় তাহলে আমি তোমার সেই আকাঙ্ক্ষাকেও পূর্ণ করব। তবে মনে রেখ, তারপরও তুমি জীবন নিয়ে পালিয়ে যেতে পারবে না। তার উপর এ শহরের প্রত্যেক সিপাহী ও প্রত্যেক নাগরিককে অনেক বেশি পণ ও জরিমানা দিতে হবে।’